ক্ষমতা দখলের দুই সপ্তাহের মাথায় কট্টরপন্থী তালেবান আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাঘলান প্রদেশে প্রখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী ফাওয়াদ আন্দারাবিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ফাওয়াদ আন্দারাবিকে আন্দারাব জেলার কিষ্ণাবাদ গ্রামে তাঁর বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে আরও জানা যায়, ঘটনার এক দিন আগে তালেবানের একটি দল চা পানের নাম করে ফাওয়াদের বাড়িতে যায় এবং তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে।
ফাওয়াদ ছিলেন একজন চারণগায়ক। উপত্যকায় উপত্যকায় ঘুরে কিচক (একতারার মতো একধরনের বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে গান গেয়ে বেড়াতেন তিনি। তাঁর অধিকাংশ গানই ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসাসঞ্জাত। তবু তালেবান তাঁকে রেহাই দেয়নি। মাত্র কয়েক দিন আগেই কাবুলে তালেবানের মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আফগানিস্তানে সংগীত আবার নিষিদ্ধ করা হবে, যেমনটি ১৯৯৬–২০০১ সাল পর্যন্ত ছিল। এই ঘোষণার তিন দিনের মাথায় ফাওয়াদকে হত্যা করা হলো। এ বিষয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাসুদ আন্দারাবি দাবি করেছেন, তালেবান যোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগীতশিল্পীদের খুঁজে বের করে তাঁদের ওপর অত্যাচার করছেন।
গত ১৫ আগস্ট তালেবান গোষ্ঠী যখন দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, অনেকেই তখন মনে করেছিলেন এবারের তালেবান হয়তোবা আগেরবারের মতো হবে না। আগেরবারের তুলনায় এবার তারা হবে অপেক্ষাকৃত নমনীয় ও সহনশীল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। যাঁরা তালেবান শাসন পছন্দ করেন, তাঁরা তো জোর দিয়েই বলছেন, এই তালেবান মোটেও আগের তালেবান হবে না। আর যাঁরা অপেক্ষাকৃত মুক্তমনা, তাঁরাও বলছেন গত ২০ বছরে বৈশ্বিক বাস্তবতা অনেক বদলে গেছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া পৃথিবীকে অনেক বদলে দিয়েছে।
এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় নিশ্চয়ই তালেবান আগের ভুল করবে না। নতুন প্রজন্মের তালেবান চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণায় আগের প্রজন্মের তুলনায় একটু ভিন্নতর হবে—এটা আশা করেছেন অনেকে। কিন্তু বোদ্ধামহলের সব হিসাব–নিকাশ উল্টে দিয়ে শিল্পী–সাহিত্যিকদের হত্যা চলছেই। ফাওয়াদ এ তালিকায় তৃতীয় বলা চলে। এর আগে প্রখ্যাত কবি ও ইতিহাসবিদ আবদুল্লাহ আতিফি এবং তারও আগে অভিনেতা নাজার মোহাম্মদকে খুন করা হয়েছে। নাজার মোহাম্মদ ছিলেন দক্ষিণ আফগানিস্তানের খুবই নামকরা অভিনেতা, যাঁকে স্থানীয় অধিবাসীরা ভালোবেসে নাম দিয়েছিল ‘খাশা জওয়ান’। তালেবান কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে আরও ঘোষণা করেছে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়ে এক কক্ষে বসতে পারবে না। এমনকি কোনো নারী শিক্ষকতার পেশায়ও থাকতে পারবেন না। এদিকে আন্দারাবির হত্যার পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড এর নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ২০ বছর পর তাদের কিছুই বদলায়নি।
নতুন প্রজন্মের তালেবান চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণায় আগের প্রজন্মের তুলনায় একটু ভিন্নতর হবে—এটা আশা করেছেন অনেকে। কিন্তু বোদ্ধামহলের সব হিসাব–নিকাশ উল্টে দিয়ে শিল্পী–সাহিত্যিকদের হত্যা চলছেই।
এই অবস্থায় আফগানিস্তানে বর্তমান তালেবানের স্বরূপ সন্ধানের প্রশ্নটি বেশ জোরেশোরেই সামনে এসেছে। বলা বাহুল্য, একটা রাজনৈতিক শক্তির স্বরূপ নির্ভর করে দুটি জিনিসের ওপর—এক, তার রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শ; দুই, তার নেতৃত্বের চরিত্র। আদর্শের দিক থেকে গত শতাব্দীর তালেবানের সঙ্গে বর্তমান তালেবানের কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। আগেও তারা ইসলামি শরিয়াহ আইনের কথা বলত, এখনো তা–ই। ওই অবস্থান থেকে তারা একচুলও নড়েছে বলে মনে হয় না।
বাকি থাকে দ্বিতীয় প্রশ্নটি, নেতৃত্ব। যতটুকু জানা যায়, বর্তমান তালেবান নেতৃত্বে অধিকতর কট্টরপন্থী হাক্কানি নেটওয়ার্ক আগের তুলনায় বেশি প্রভাব নিয়ে আছে। শুরুতে আলাদা স্বাতন্ত্র্য নিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন হাক্কানি ১৯৯৫ সালে তালেবানের সঙ্গে একীভূত হন। ২০১৪ কিংবা ২০১৫–তে মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সিরাজুদ্দিন হাক্কানি নেটওয়ার্কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুর্ধর্ষতার দিক থেকে আল-কায়েদার পরই এই নেটওয়ার্ককে মনে করা হয়। বর্তমানে সিরাজুদ্দিন তালেবানের প্রথম ডেপুটি। তাঁর আরেক ভাই আনাস হাক্কানিও তালেবানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অংশ। সেই হিসেবে অনেকেই মনে করেন, হাক্কানি ভ্রাতৃদ্বয়ই বর্তমানে তালেবানের মূল চালিকা শক্তি। যদি তা–ই হয়, তাহলে এ কথা মানতেই হবে যে তালেবান আন্দোলন বর্তমানে মোল্লা ওমরের চেয়ে কম কট্টরপন্থীদের হাতে নয়। তাই তাদের আচরণে খুব একটা রকমফের হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
অনেকেই আবার মনে করেন, তালেবানের ভেতরে দুটি ধারা প্রবহমান। কয়েক বছর ধরে যে গ্রুপটি কাতারে বসবাস করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ওঠবস করেছে, তারা অপেক্ষাকৃত নমনীয় প্রকৃতির। তারা অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। এ জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার পক্ষপাতিও তারা। এরই প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের দোহা অফিসের মুখপাত্রের কথায়। ক্ষমতা দখলের পরপরই দোহা অফিসের মুখপাত্র সুহাইল হোসাইন বলেছিলেন যে এইবার তাঁদের সরকার ইসলামি নির্দেশনার ভেতরে থেকে নারী স্বাধীনতা, নারীর শিক্ষা ও মানবাধিকার ইস্যুগুলোকে মর্যাদা দেবে। কিন্তু এক দিন পরই আফগানিস্তানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ তা সরাসরি নাকচ করে দিয়ে নারীর স্বাধীনতা, সংগীত—এসবকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তাই তালেবানের এই অংশ, অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল অংশটি যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় একক আধিপত্যে এসে যায়, তাহলে তালেবানের আচরণে তেমন একটা পরিবর্তন আশা করা যায় না।
তবে তালেবান যদি সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধির সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত একটা ইনক্লুসিভ সরকার গঠন করতে পারে তাহলে হয়তো তালেবানের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে। তা না হলে দেশটি আবার ফিরে যাবে গত শতাব্দীর শেষ দশকে। তবে মনে রাখতে হবে, তালেবান গোষ্ঠী যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী নয় এবং তারা যা বিশ্বাস করে, তাতে সমন্বয়ের সুযোগ খুবই সীমিত। তাই তাদের কাছ থেকে খুব একটা পরিবর্তন আশা করা হবে একধরনের উচ্চাভিলাষ।
মোশতাক আহমেদ আফগানিস্তানে সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা