২০১৩ সালে রাজধানীতে হেফাজতে ইসলাম প্রথম সংঘবদ্ধ শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিল। তারা জাতীয় মসজিদকে সংঘাত ও নাশকতার কাজে ব্যবহার করেছিল। সরকার প্রথমে পুলিশি শক্তি ব্যবহার করে তাদের দমন করলেও দীর্ঘ মেয়াদে একটি সমঝোতার পথ খুঁজেছিল। হেফাজতের তৎকালীন শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একটা আপসেও পৌঁছেছিল। তাতে হেফাজত লাভবান হলেও সমঝোতা টেকসই হয়নি।
সাধারণ শিক্ষার মতো দেশের মাদ্রাসাশিক্ষারও অনেকগুলো ধারা। তবে প্রধান দুটি হলো সরকারি মাদ্রাসা বোর্ডের অধীন দারুল উলুম বা আলিয়া মাদ্রাসা এবং বেসরকারি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ সংক্ষেপে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের
অধীনে পরিচালিত কওমি মাদ্রাসা। ১৯১৪ সালে নাথান কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মাদ্রাসাশিক্ষা সংস্কার করে পাঠ্যসূচিতে বাংলা, ইংরেজিসহ বিজ্ঞান ও মানবিক বিদ্যার কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিউ স্কিম নামে পরিচিত এই সংস্কার কেবল প্রথমোক্ত ধারাটিতে কার্যকর হয়। এর ফলেই প্রথম জীবনে মাদ্রাসাশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক বাঙালি মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছিল, যাঁরা বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ জীবনের মূলধারায় অগ্রসরজনরূপে স্বীকৃত হয়েছেন।
কওমি মাদ্রাসা ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারী। ১৮৬৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম মাওলানা মুহম্মদ কাসিম। বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে মাওলানা আশরাফ আলী থানভি ছিলেন এই ধারার প্রভাবশালী আলেম, যাঁর রচিত খুতবা একালেও অনুসৃত হয়। এঁদের চর্চিত ধারাটি রক্ষণশীল ওয়াহাবি পন্থা হিসেবেও পরিচিত। একসময় সুন্নিদের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল তীব্র। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ঘটতে থাকে এবং সত্তরের দশক থেকে তেলের কারণে আরব বিশ্বের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগোষ্ঠীর কিছু মহলে বিপ্লবী ইসলাম থেকে ক্রমে জিহাদি ও জঙ্গি ইসলামি রাজনীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ দেশের সমাজে এর পক্ষে যে সক্রিয় গোষ্ঠীগুলো তৈরি হয়েছে, তাদের একটি উৎস মাদ্রাসা, বিশেষত কওমি মাদ্রাসা। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল রাজনীতির অবক্ষয় ও সর্বত্র উগ্র সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং ইরাক-আফগানিস্তান হয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ধ্বংসাত্মক ভূমিকা স্বভাবতই মুসলমানদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। এতে সমাজে ইসলামি কট্টরপন্থী রাজনীতির ঝোঁকও বেড়েছে। এরা প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। সরকারের আপসনীতির খেসারত হিসেবেও একে দেখছেন অনেকে।
বাস্তবতা হলো, আজ চিকিৎসা (ওষুধ থেকে পরীক্ষার যন্ত্রপাতি) থেকে হজব্রত পালন (উড়োজাহাজ থেকে শীতাতপব্যবস্থা), খাদ্য থেকে ল্যাপটপ, জ্ঞান থেকে চলাচল, নাগরিক পরিষেবা থেকে বিনোদন—কোথাও কারও পক্ষেই শুধু নিজ ধর্ম-সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকা সম্ভব নয়।
সংস্কারের যত চেষ্টাই হোক না কেন, দেওবন্দে আধুনিক সমকালীন বিদ্যা সংযোজনে আগ্রহী হননি এর পরিচালকেরা। দেওবন্দের পাঠ্যতালিকা কোরআন, হাদিস, তফসির, ফিকহ্, কালামে সীমাবদ্ধ, যা এ দেশের কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও সত্য। ১৯৩৮ সালে গঠিত মওলা বকস্ কমিটি মাদ্রাসাশিক্ষা সংস্কারে যে প্রতিবেদন দেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মাওলানা মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, শত বছরের চেষ্টাতেও মাদ্রাসাশিক্ষায় কোনো পরিবর্তন আনা যায়নি, এগুলো চলছে বাদশাহ আলমগীরের আমলের শিক্ষাব্যবস্থায়। একই রকম হতাশা ব্যক্ত করেছেন নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী, ড. মাহমুদ হাসান প্রমুখ উপমহাদেশের প্রথম প্রজন্মের মুসলিম বিদ্বজ্জন।
গত ২৬ মার্চ হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদ সমাবেশে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা ঘটেছে, সেদিকে নজর দিলে আমরা বুঝতে পারব তাদের চিন্তাধারার ধরন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাদের আক্রোশ প্রবল, উপমহাদেশের সর্বমান্য সংগীতসাধক ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই কৃতী সন্তান ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই, সরকারি দপ্তরে ধ্বংসাত্মক হামলায় বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের নেতিবাচক মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটে। তারা জাতীয় সংগীত গ্রহণ করে না, জাতীয় পতাকার প্রতিও সম্মান প্রদর্শনে অনিচ্ছুক। আদতে সংবিধান, গণতন্ত্র, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, জাতীয় শিক্ষানীতি, বাঙালির সামাজিক রুচি-রীতি অর্থাৎ এ জাতি দীর্ঘ সংগ্রাম করে রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক জীবনের জন্য যা কিছু অর্জন করেছিল, তার অনেক কিছুই এরা মানে না। এ যেন রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র।
কারও জন্যই রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অবস্থান কাম্য নয়। এ চিন্তাধারা এই সমাজে বহুকালের একটি বহমান ধারা। কেবল আইন ও পুলিশি ব্যবস্থায় এর সুরাহা হবে না। তবে স্বাধীনতা দিবস ও পরের কয়েক দিনে যেসব ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার বিচার করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। দোষীদের ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরও বুঝতে হবে, রাষ্ট্র সংবিধান ও আইনের পথেই চলতে বাধ্য। এখানে শৈথিল্য বা দ্বিচারিতা সম্ভব নয়। ফলে হেফাজতের নেতাদেরই অনুধাবন করতে হবে যে রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি ও সংঘাতময় অবস্থানে তাঁরা যাবেন কি না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতা ও অবিবেচক কাজের যে বহিঃপ্রকাশ জাতি দেখেছে, তা যেকোনো সচেতন মানুষকেই দুঃখিত ও হতাশ করেছে। আমরা সবাই জানি, মানবসমাজে সংঘাত-ধ্বংসে সমাধান আসে না, আসে আলোচনায়-সমঝোতায়, প্রতিহিংসা বা জিঘাংসায় নয়, আসে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের পর থেকে মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে যে বিপুল বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তা দেশ, জাতি, ধর্মনির্বিশেষে সবার জীবনে গভীরভাবে ছাপ ও প্রভাব ফেলছে। আজকের দিনে কোনো মানুষের পক্ষেই বিচ্ছিন্নভাবে জীবনধারণ সম্ভব নয়। বিশ্বায়নের প্রভাব তো সত্য, এ পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। এতে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী বিশ্বের আগ্রাসী মুক্তবাজার অর্থনীতির কৌশল বাস্তব সত্য বটে, তবে তা-ই সত্যের সবটা নয়। নিজেদের প্রয়োজনে ও কল্যাণে অন্যরাও বা আমরাও তাদের অধমর্ণ হয়েছি। এ প্রক্রিয়া এক দিনের নয়, প্রথম শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই এই লেনদেন চলছে। এতে খ্রিষ্টান পশ্চিমা বিশ্ব ধর্মীয় কারণে নয়, মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নততর জীবন-সহায়ক উপকরণ তৈরি এবং পুঁজিবাদী বাজার প্রক্রিয়ার কারণে উত্তমর্ণের ভূমিকায় রয়েছে। মুসলিম বিশ্বে তাদের জন্য কাজটা সহজ হয়েছে, কারণ যে আরব জ্ঞান ও সভ্যতার মারফত পশ্চিম একদিন প্রাচীন গ্রিসের বিজ্ঞান ও দর্শনের সন্ধান পেয়েছিল, তারাই পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে জ্ঞানবিমুখ অবস্থানে অনড় হয়ে রয়েছে।
বাস্তবতা হলো, আজ চিকিৎসা (ওষুধ থেকে পরীক্ষার যন্ত্রপাতি) থেকে হজব্রত পালন (উড়োজাহাজ থেকে শীতাতপব্যবস্থা), খাদ্য থেকে ল্যাপটপ, জ্ঞান থেকে চলাচল, নাগরিক পরিষেবা থেকে বিনোদন—কোথাও কারও পক্ষেই শুধু নিজ ধর্ম-সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকা সম্ভব নয়। আর যেসব কোম্পানি আজ এগুলো উৎপাদন-বিপণন করছে, তাতে কত দেশের কত ধর্মের (কিংবা ধর্মে অবিশ্বাসী) মানুষের হাত লেগেছে, তার হিসাব কে রাখবে?
আবিষ্কার বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে মুসলমানরা পিছিয়ে থাকলেও তার জন্য হীনম্মন্যতায় ভোগা বা অন্যের প্রতি ক্রোধ-বিদ্বেষ পোষণের প্রয়োজন নেই। জরুরি হলো পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো অনুধাবন ও প্রতিকারের পথ অনুসন্ধান। সশস্ত্র জঙ্গিবাদে সমাধান মেলেনি আবার পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতার ঘুঁটি হয়ে যে বিজয়, তার স্থায়িত্ব নেই। তাদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে কেন, কীভাবে কর্তৃত্ব হাতছাড়া হয়েছে ও তারা অর্জন করেছে ও তাদের হাতে তা বজায় থাকছে, সেটাই উপলব্ধি করতে হবে। আস্ফালন কিংবা ধ্বংসাত্মক কাজে ফায়দা না খুঁজে তালেবান-আইএসের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেওয়াই দূরদর্শী কাজ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতা ও অবিবেচক কাজের যে বহিঃপ্রকাশ জাতি দেখেছে, তা যেকোনো সচেতন মানুষকেই দুঃখিত ও হতাশ করেছে। আমরা সবাই জানি, মানবসমাজে সংঘাত-ধ্বংসে সমাধান আসে না, আসে আলোচনায়-সমঝোতায়, প্রতিহিংসা বা জিঘাংসায় নয়, আসে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়।
আমাদের মনে হয়, একদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ সামগ্রিক ইতিহাস, বাঙালি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং ইউরোপের রেনেসাঁস ও আলোকন, শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী বিশ্ব ইতিহাস ও মানবজীবনে তার যুগান্তকারী সামূহিক প্রভাব বোঝা যেমন প্রয়োজন, তেমনি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও দর্শন এবং দর্শন-বিজ্ঞান-শিল্পসাহিত্য, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি চিরায়ত ও আধুনিক বিষয়ে মুসলিম সভ্যতার অর্জন-অবদান সম্পর্কে জানা এবং উভয়ের বোঝাপড়া আজ একান্ত জরুরি। রাষ্ট্র অবশ্যই তার দায়িত্ব পালন করবে কিন্তু এই সংকটের সবটা রাষ্ট্রের আওতায় ধরা যাবে না, কেননা মৌলিকভাবে এটি মুসলিম সমাজের বোঝাপড়ার সংকট। এ নিয়ে সমাজে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক নানা পর্যায়ে আলোচনা-কথাবার্তা হওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তাদের তদন্তসংশ্লিষ্ট যত বিভাগ আছে ও জ্ঞানীজন রয়েছেন, তাঁরা উদ্যোগী হলে ভালো হবে। এভাবেই ধর্ম ও সম্প্রদায় উভয়ের হেফাজত সম্ভব হবে।
● আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক