এ মুহূর্তে অনলাইনে পাঠদানের বিকল্প নেই
কোভিড মহামারির কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিন মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে। কবে খুলে দেওয়া সম্ভব হবে তা নিশ্চিত নয়। এই পরিস্থিতিতে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নানা সমস্যা নিয়ে অনলাইনে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনা থেকে দূরে সরে না যায়, যেন বড় রকমের সেশনজট না হয় এবং দীর্ঘ সময় পড়াশোনার বাইরে থাকার ফলে মানসিকভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার না হয়।
অনলাইনে পাঠদানের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যেমন শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করে, যেখানে ইন্টারনেট সুবিধা সীমিত এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন নয়; সব শিক্ষার্থীর নিজের কম্পিউটার নেই; সবার পর্যাপ্ত ডেটা কেনার সামর্থ্য নেই ইত্যাদি। তবে ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটারের বিকল্প হিসেবে স্মার্টফোনে অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব। এবং তুলনামূলক কম দামে ভালো মানের স্মার্টফোন পাওয়া যায়। আর কোনো শিক্ষার্থী কারিগরি বা ব্যক্তিগত কারণে রুটিনের নির্ধারিত সময়ে অনলাইন ক্লাস মিস করলে, তাদের জন্য শিক্ষক ক্লাসের পাঠ্যবিষয় ও বক্তৃতা রেকর্ড করে ইন্টারনেটে আপলোড করবেন; যাতে শিক্ষার্থী সুবিধামতো সময়ে তা ডাউনলোড করে পড়তে পারে, প্রয়োজনে ফোন বা ই–মেইলে শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে পারে।
অনলাইনে ক্লাস করার জন্য একটি ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনতে ৩৫-৪০ হাজার এবং মোটামুটি মানসম্পন্ন স্মার্টফোন কিনতে ১২-১৫ হাজার মিলিয়ে এ দুটি যন্ত্রের জন্য একজন শিক্ষার্থীর মোট ব্যয় সম্ভাব্য ৫৫ হাজার টাকা ধরলে মাস্টার্স পর্যন্ত ৫ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই খাতে তার মাসিক গড় ব্যয় ১০০০ টাকারও কম। মোবাইল ডেটার জন্য মাসে ১ হাজার টাকা যোগ দিলে মাসিক ব্যয় হয় ২ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসা-যাওয়ার খরচ নেই, নিজ বাড়িতে থাকায় থাকা-খাওয়ার খরচেও সাশ্রয় হয়। তা ছাড়া কিস্তিতে ক্রয়, ব্যাংকের শিক্ষা ঋণ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি বা টিউশন ফিতে ছাড় মোট ব্যয়ের চাপ কমাতে পারে। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করোনাকালে টিউশন ফিতে ছাড় ও কিস্তিতে ফি পরিশোধ সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে। তবে প্রোগ্রামের ধরন এবং শিক্ষা অবকাঠামোর বিবেচনায় সমপর্যায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবার টিউশন ফি এক রকম নয় বলে আর্থিক সুবিধার পার্থক্য থাকতে পারে।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদানের জন্য যথাযথ অবকাঠামো ও কারিগরি সরঞ্জাম নেই। শিক্ষকদের অনেকে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনায় যথেষ্ট প্রস্তুত নন। এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের অনলাইনে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস পরিচালনা; অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ ও পাঠ চলাকালীন মূল্যায়নের অন্যান্য পদ্ধতির কার্যকর ব্যবহার রপ্ত করতে হবে।
এসব সমস্যা বাস্তব। কিন্তু সে জন্য অনির্দিষ্টকাল ধরে পড়ালেখা বন্ধ রেখে জীবনের মূল্যবান সময়ের অপচয় কাম্য হতে পারে না। তাই অনলাইনে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা সারা পৃথিবীতেই একটি উত্তম বিকল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এখন তা বেশ কার্যকরভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও তা না করার কোনো যুক্তি নেই।
অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে:
ক. পাঠ বা প্রশিক্ষণের ধরন ও বিষয়।
খ. শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ইন্টার–অ্যাকশনের ব্যাপ্তি ও প্রক্রিয়া এবং
গ. শিক্ষা কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি।
আপাতত একটি বড় সমস্যা হচ্ছে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেওয়ার জন্য ব্যবহার উপযোগী সফটওয়্যার নেই।
এ ছাড়া অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ও যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। কেউ গুগল সার্চ বা অন্য কোনো উপায়ে নকল করে পরীক্ষায় উত্তর লিখছে কি না, তা নিরূপণ করা কঠিন।
প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য কার্যকর সফটওয়্যার উদ্ভাবন করতে হবে, অনলাইনে নানা ধরনের কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রোজেক্ট পেপার তৈরি এবং ডিফেন্স, মৌখিক পরীক্ষা, ওপেন বুক পদ্ধতিসহ অন্যান্য ধরনের লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে শিক্ষাকার্যক্রমকে নিয়মিত রাখতে হবে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন বিষয় ও প্রোগ্রামে কোর্স পরিচালনা করে। প্রচলিত পুরোনো ব্যবস্থায় সেমিস্টার বা ট্রাইমিস্টার পদ্ধতিতে সব মিলিয়ে বছরে এক, দুই বা তিনবার ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এসবের সমন্বয় একটা সমস্যা। আবার একাডেমিক ক্যালেন্ডার বিঘ্নিত হলে ভর্তি কার্যক্রম ব্যহত হয়, বিচ্ছিন্নভাবে সারা বছরই ভর্তি চলে। ভর্তির জন্য একক পদ্ধতি কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে বিতর্ক থাকবে, ভর্তি পরীক্ষার সময় সমন্বয়ও সহজ হবে না।
তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং যথাযথ সফটওয়্যার ব্যবহার করে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। আর শিক্ষার্থীদের এক সেমিস্টার ফাইনাল শেষে নতুন সেমিস্টারে ভর্তি, অ্যাডভাইজিং, ওরিয়েন্টেশন এসবও অনলাইনে আয়োজন করা সহজ।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের ফি দিয়েই শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও ইউটিলিটিসহ যাবতীয় ব্যয় মিটিয়ে থাকে। শিক্ষাকার্যক্রমের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ, সরকার কোন পক্ষ কীভাবে এবং কত পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। এখন সব পক্ষের সহযোগিতায় শিক্ষাকার্যক্রম অব্যহত রাখতে হবে, অনলাইনে শিক্ষার জন্য পরিকাঠামো ও দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের সামর্থ্য অর্জন করে এবং আর্থিক ব্যয় ও ফি কাঠামো যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে নিয়মনীতি অনুসরণ করে ভালোভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে, সে জন্য সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, অনলাইনে পড়ালেখার নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা আছে এই যুক্তিতে এর বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে সবার উচিত হবে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রমকে কীভাবে অধিকতর কার্যকর করা যায়; যন্ত্রপাতি, প্রোগ্রাম, কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, এসব নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার বিষয়বস্তু সম্প্রসারণ, পর্যালোচনা, শিক্ষার্থীদের পাঠ অনুধাবনের মাত্রা যাচাইয়ের কাঠামো ও ব্যাপ্তি ইত্যাদি সফটওয়্যারের আওতাভুক্ত করার উপায় বের করতে হবে। বুঝতে হবে অনলাইনে পড়ালেখা সময় বাঁচায়, বিশ্বজুড়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারে।
দুঃখের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী নানা অজুহাতে অনলাইনে পাঠদানের বিরোধিতা করছে। কেউ কেউ অনলাইনে অনুষ্ঠিত ক্লাসে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন করতে উৎসাহিত করছে। তারা বুঝতেই পারছে না যে এভাবে তাদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। আমরা কেউই নিশ্চিত নই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কত দিন সময় লাগবে। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার তথা আমরা সবাই মনেপ্রাণে এখনকার দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই, ফিরে পেতে চাই বরাবরের স্বাভাবিক পরিবেশ। তত দিন সবার সহযোগিতায় শিক্ষাকার্যক্রম অব্যহত থাকুক, মহান আল্লাহ পাক আমাদের সহায় হোন।
ড. এস এম মাহফুজুর রহমান, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য।