কদিন আগে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে গিয়েছিলাম অ্যাসোসিও আইসিটি সামিট ২০১৬-তে। এই সম্মেলনে বিশেষজ্ঞ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি–শিল্প খাতের নেতৃস্থানীয় মানুষের কথায় একটা বিষয় বারবার এসেছে, তা হলো ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’। আসলে এখন আমরা ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আইবিএম এশিয়া প্যাসিফিকের ডিজিটাল লিডার সিমন থমাসের একটি অধিবেশনে বিষয়টি পরিষ্কারও হলো। তাঁর উপস্থাপনায় তিনি বললেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খুচরা পণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান আমাজন ডটকম কিংবা আলীবাবার কোনো বড় দোকান নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিডিয়া এখন ফেসবুক। কিন্তু ফেসবুক নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না। আরও একটি উদাহরণ হলো উবার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবহন সরবরাহকারী উবারের নিজস্ব কোনো পরিবহন নেই, নেই গ্যারেজ বা অন্য কোনো অবকাঠামো। সাইমনের উপস্থাপনায় একটা বিষয় পরিষ্কার হলো, এখন যে ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা কিন্তু অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল যন্ত্রে যাওয়ার ব্যাপার নয়। ডিজিটাল যন্ত্র এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির নতুন আকার-প্রকার, ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা পাওয়া এই রূপান্তরের আসল ব্যাপার।
সেদিন এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁর মেয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাবা ঢাকা থেকে ফোন করে মেয়ের খোঁজখবর নিচ্ছেন। ফোনে মেয়ে বলল, কলেজ থেকে শপিংয়ে যাচ্ছে। মেয়ে যেহেতু ওই দেশে নতুন, তাই বাবার প্রশ্ন, ‘যাচ্ছ কীভাবে?’ ‘উবার করে ট্যাক্সি নিয়ে যাচ্ছি’—মেয়ের উত্তর। ২২ নভেম্বর বাংলাদেশে যখন উবার চালু হলো, ঢাকা শহরের কিছু কিছু এলাকায় উবারের মাধ্যমে ট্যাক্সি পাওয়া যেতে শুরু হলো—তখন বেশ ভালো লেগেছিল। ঢাকা শহরে এখন ট্যাক্সি পাওয়ার জন্য যে কসরত করতে হয়, সেখানে কয়েকবার আঙুল চালাচালি করে ট্যাক্সি পাওয়া তো দারুণ ব্যাপার। ৭৮টি দেশের ৫৪০টি শহরে উবার চলে। দক্ষিণ এশিয়ার ৩৩তম শহর হিসেবে ঢাকা উবারে সর্বশেষ যুক্ত হওয়া শহর।
উবার চালু হওয়ার পরই মুঠোফোনে উবার অ্যাপ নামিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি এটা কীভাবে কাজ করে। নিজের অবস্থানকে ঘিরে আশপাশে কোথায় ট্যাক্সি আছে, তা মানচিত্রেই দেখা যায়। কোথায় যেতে চাই সেই ঠিকানা লিখে দিলে দূরত্ব, সম্ভাব্য ভাড়া, চালকের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়—সবই চলে আসে। বাহ্ বেশ ভালোই তো। উবারের মাধ্যমে ট্যাক্সি নিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করেছেন এমন কয়েকজনের কাছে জানা গেল তাঁদের অভিজ্ঞতা ভালো। মনে কিছুটা সংশয় থাকেই, ঢাকায় উবার চলবে তো? সংশয়টা সত্যিতে পরিণত হলো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২৫ নভেম্বর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিল, স্মার্টফোনে উবারের মাধ্যমে ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস বেআইনি।
বিআরটিএ উবারকে বিরত থাকতে বলেছে। কারণ, বিআরটিএ তথা সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো ট্যাক্সি সার্ভিস প্রদান করা অবৈধ, বেআইনি, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ট্যাক্সি–সেবা পরিচালিত হয় ‘ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন ২০১০’ মোতাবেক। উবারের সেই অনুমতি নেই। সর্বশেষ তথ্য হলো বিআরটিএ অবৈধ ঘোষণা করলেও উবারের ট্যাক্সি–সেবা চলছে। উবারের বাংলাদেশি প্রতিনিধিরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন।
মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালিত এই সেবা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নতুন উদ্যোগের (স্টার্টআপ) বিবেচনায় বর্তমান সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত। উবার কোনো প্রচলিত ট্যাক্সি পরিবহন–সেবা দেয় না। গাড়িচালক ও যাত্রীর মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়। উবারের স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভাড়ায় গাড়ি চালান এমন চালক নিবন্ধিত হতে পারেন। আর স্মার্টফোনে অ্যাপ নামিয়ে নিবন্ধিত হবেন যাত্রী। গাড়ির খোঁজ পেলে চালকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে নেবেন। বাংলাদেশে উবারের অংশীদার গ্রামীণফোন। উবার কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, নিবন্ধিত চালকদের অ্যাপ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তাঁদের ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ ও বৈধ আছে কি না, তা দেখা হয়। গাড়ি কখন, কোথায় যাচ্ছে তা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিটি গাড়িতেই গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস)-নির্ভর ট্র্যাকিং সিস্টেম রয়েছে।
উবারের অ্যাপভিত্তিক সেবার জনপ্রিয়তা যেমন আছে, তেমনি কিছু বিতর্ক, বিধিনিষেধ রয়েছে উবার নিয়ে। তাইপে শহরে উবার বন্ধ। দিল্লিতে ২০১৪ সালে উবার নিবন্ধিত এক চালকের ট্যাক্সিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটায় উবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে আবার এই সেবা চালু করা হয়। তবে এমন ঘটনা যেকোনো পরিবহনেই ঘটতে পারে। দিল্লিতে বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, বাংলাদেশেও নজির আছে। এগুলো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা।
উবার একটি ‘ডিজিটাল সেবা’ না ‘পরিবহন কোম্পানি’ এ নিয়ে বিতর্ক আছে। উবার নিজেদের ডিজিটাল সার্ভিস হিসেবেই বলতে চায়। এটা গাড়িচালকের সঙ্গে যাত্রীর সংযোগ ঘটিয়ে দেয়। সে হিসেবে ট্যাক্সি বা পরিবহন কোম্পানির সঙ্গে উবারের পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। ক্লাসিফায়েড ওয়েবসাইটগুলো যেমন ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে ওয়েবসাইট বা অ্যাপের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দেয়। বেচাকেনার যে লেনদেন হয়, তা ক্রেতা-বিক্রেতা নিজ দায়িত্বে করে থাকেন।
বিআরটিএ যে কারণে উবারকে অবৈধ বলছে, সেটা এই ডিজিটাল রূপান্তরের সময় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অ্যাপ দিয়ে এই ঢাকা শহরেই আমরা নানা রেস্তোরাঁয় খাবারের চাহিদা জানাতে পারছি, বাজার-সদাইয়ে ফরমাশ দিতে পারছি—আর পণ্য বাসায় পৌঁছার পর তার মূল্য পরিশোধ করছি। এসব ডিজিটাল সেবা সময় ও ঝক্কি দুটোই কমায়। উদ্ভাবনী এসব স্টার্টআপ অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ধারণা বা উদ্ভাবন দিয়ে বাজিমাত করার সুযোগ।
উবার অবৈধ ঘোষণার পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, উবার বন্ধ করার ইচ্ছে সরকারের নেই। তবে আইনি কাঠামোর মধ্যে তা থাকতে হবে। ২০১০ সালে প্রণীত ট্যাক্সিক্যাব গাইডলাইন দিয়ে এখন তো আর চলবে না। ডিজিটাল রূপান্তরে জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন ব্যবস্থা। নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অনেক কিছুই। ঢাকা শহরে দুটি কোম্পানি ট্যাক্সি–সেবা পরিচালনা করছে। প্রায় ১৮ হাজার গাড়ি ট্যাক্সি হিসেবে নিবন্ধিত। কিন্তু ভুক্তভোগীরা জানেন ঢাকার রাস্তায় ট্যাক্সি সার্ভিস কতখানি বাজে। তাই উবারের মতো আধুনিক ধারণা নগরজীবনে যাতায়াতের বিষয়টিকে স্বস্তিদায়ক করে তুলবে। বিআরটিএকে উবারের ব্যাপারটি পুরোপুরি বুঝতে হবে। কোনো বিশেষ মহলের স্বার্থ না দেখে উবার চালু রাখা উচিত। এতে নাগরিকদের সুবিধাই হবে বেশি।
পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক।