‘স্বাস্থ্যই প্রথম’—মানি আর না মানি, এটাই করোনার শিক্ষা। ভবিষ্যতে সেই জাতিই সমৃদ্ধি, মর্যাদা ও নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হবে, যে জাতি করোনার এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে সংস্কার করবে। এর প্রমাণ তো বর্তমানেই বিরাজমান। এখন স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন না আনলে জনগণ উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে তো বঞ্চিত হবেই, উন্নয়নের ধারাও অব্যাহত রাখা কঠিন হবে। উল্লেখ্য, ২০৪১ সালে আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০ কিংবা ৩০ হাজার ডলার হলেও মানুষ উন্নয়নের স্বাদ নিতে পারবে না, যদি দেশ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার জোগান দিতে ব্যর্থ হয়। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতিকারমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই নজর দেওয়া প্রয়োজন প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর। এখানে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়া হলো।
প্রথমত প্রাক্-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ খাবার গ্রহণ, স্বাস্থ্য গঠন ও রোগ প্রতিরোধে ‘স্বাস্থ্য ও পুষ্টি শিক্ষা’ কার্যক্রম চালু করতে হবে। এর জন্য একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করতে হবে। যার অধীনে প্রতিটি থানা, উপজেলা, জেলা ও বিভাগে ‘স্বাস্থ্য ও পুষ্টি শিক্ষা’ অফিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অধীন এ–সংক্রান্ত দপ্তরও থাকবে। এই ধারার পদগুলো পর্যায়ক্রমে হতে পারে ‘স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রশিক্ষক’ (গ্রেড-১২), ‘সহকারী স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা’ (গ্রেড-৯), ‘সিনিয়র সহকারী স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা’, ‘ডেপুটি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা’, ‘যুগ্ম স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা’, ‘অতিরিক্ত স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা’ এবং ‘প্রধান স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা’ (গ্রেড-১)।
উপজেলা বা থানা পর্যায়ে দুই থেকে চারজন ‘স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রশিক্ষক’, একজন ‘সহকারী স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা’ এবং একজন ‘সিনিয়র সহকারী স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মকর্তা’ (যিনি উপজেলা বা থানা অফিসের প্রধান হবেন) থাকবেন। বিদ্যমান ‘হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট’ এবং ‘হেলথ ইন্সপেক্টর’ পদ দুটি এই ধারার সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে সংগতি রেখে জেলা, বিভাগ, অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয় পর্যায়ের অফিসের অর্গানোগ্রাম তৈরি করা যেতে পারে। উপজেলা বা থানা অফিস নিয়মিতভাবে স্কুল ও মাদ্রাসার নতুন প্রণীত ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা’ বিষয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ শিখন কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা দেবে।
২০৪১ সালে আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০ কিংবা ৩০ হাজার ডলার হলেও মানুষ উন্নয়নের স্বাদ নিতে পারবে না, যদি দেশ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার জোগান দিতে ব্যর্থ হয়। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতিকারমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এই ধারার জনবলের উন্নত প্রশিক্ষণসহ ছোঁয়াচে ও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আইইডিসিআরকে পুনর্গঠন করে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির মতো একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য নিপসম, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি ইনস্টিটিউটকে একীভূত করে ইউনিভার্সিটি ফর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস কন্ট্রোল নামে একটি বিশেষায়িত ইউনিভার্সিটি গড়ে তোলাও প্রয়োজন।
প্রতিরোধ ও প্রমোশনাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার নতুন এই ধারা প্রবর্তনের পাশাপাশি গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিক কাঠামোও শক্তিশালী করতে হবে। এর জন্য প্রথমে কমিউনিটি ক্লিনিকের বর্তমান শূন্য পদে সিএইচসিপি হিসেবে প্যারামেডিক, নার্স বা মিডওয়াইফারি নিয়োগ করতে হবে। এর ধারা অব্যাহত রেখে পর্যায়ক্রমে ২০৩০ সালের মধ্যে সব কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে স্তন, মুখগহ্বর ও জরায়ুমুখের ক্যানসার স্ক্রিনিং চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া রোগ নির্ণয়ের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকে পয়েন্ট অব কেয়ার বা স্ট্রিপভিত্তিক ডায়াগনস্টিক সেবার প্রচলন করতে হবে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রগুলোয় সব শূন্য পদে জনবল নিয়োগ করে পরিবার পরিকল্পনা সেবা জোরদার করতে হবে। এখানেও কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো পর্যায়ক্রমে স্ট্রিপভিত্তিক ডায়াগনস্টিক সেবা ও ক্যানসার স্ক্রিনিং চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের একটা কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ‘উপজেলা হাসপাতাল’ নামে নামকরণ ও এর অর্গানোগ্রামকে যুগোপযোগী করে সহায়ক স্টাফসহ সব পদ নিয়মিতভাবে পূরণ করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট এবং ১১টি মেডিকেল অফিসার বা সমমানের পদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদই শূন্য। মেডিসিন, গাইনি অ্যান্ড অবস, পেডিয়াট্রিকসহ যে কটি পদে জুনিয়র কনসালট্যান্ট নিয়মিত পদায়ন করা হয়, তারাও প্রয়োজনীয় সহায়ক জনবল এবং অবকাঠামোর অভাবে সেবা দিতে পারে না। জরুরি বিভাগসহ হাসপাতাল মূলত পরিচালিত হয় মুষ্টিমেয় মেডিকেল অফিসার দ্বারা। তাই মেডিকেল অফিসার পদের সংখ্যা বাড়িয়ে ন্যূনতম ২০–এ উন্নীত করা দরকার, যার মধ্যে ৫টি হবে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার।
উল্লেখ্য, জরুরি বিভাগ শক্তিশালীকরণে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, ইকুইপমেন্টসহ (যেমন সাকশন মেশিন, অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজার, ‘মিনি ওটি’, ওয়াশ ইকুইপমেন্ট) প্রতি শিফটে কমপক্ষে একজন ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, একজন স্যাকমো, দুজন নার্স, একজন মেডিকেল অ্যাটেনডেন্ট ও একজন আয়ার সমন্বয়ে একটি প্রশিক্ষিত টিম গড়ে তুলতে হবে। তা ছাড়া প্যাথলজিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, আয়া, ক্লিনারসহ সব ক্লিনিক্যাল ও নন-ক্লিনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফের প্রয়োজনীয় সংখ্যা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী পদ সৃষ্টি ও পদায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। অত্যাবশ্যকীয়, ডায়াগনস্টিক সেবা নিয়মিতকরণে প্রয়োজনে পাবলিক, প্রাইভেট, পার্টনারশিপ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। তা ছাড়া মেডিসিন স্টোর আধুনিকায়ন ও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে ওষুধ সংরক্ষণ ও বিতরণব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
আইন অনুযায়ী শহর অঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার হলেও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোযোগের অভাব, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে না তোলা, লোকবলের অভাব এবং সর্বোপরি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যদশার ফলে তাদের পক্ষে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই শহর অঞ্চলেও প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি আরবান কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা প্রয়োজন। তবে শহরের জনসংখ্যার আধিক্য ও চাহিদা বিবেচনায় রেখে এটির কাঠামো, শিফটের সংখ্যা, সেবাদানকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। মহানগরীর ক্ষেত্রে দুটি শিফটে সেবাদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি শিফটে একজন মেডিকেল অফিসার, দুজন নার্স, প্যারামেডিক, মিডওয়াইফারি, প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকাদানকারী এবং একজন নিরাপত্তারক্ষী থাকতে পারে। এখানেও কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো স্ট্রিপভিত্তিক ডায়াগনস্টিক সেবা ও ক্যানসার স্ক্রিনিং সেবার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আশা করি, এই রূপরেখা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সরকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি শক্তিশালী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে উন্নয়নের স্বাদ আস্বাদনে সহযোগিতা করবে।
● ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়