প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্যে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলা নিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগ গঠনের ব্যাপারে সম্প্রতি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বৃহত্তর ময়মনসিংহে ছিল ছয়টি জেলা; সংক্ষেপে জেলাগুলোর আদ্যক্ষর নিয়ে বলা হতো: টানেসেকিমজা! (আগে ‘সেরপুর’ বানান এভাবেই লেখা হতো।) ময়মনসিংহ বিভাগে এখন আগের ‘মজা’ পাওয়া যাবে না। কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল অনেক দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল, তাদের যেন ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত না করা হয়। সেটাই বাস্তবায়িত হলো।
যে মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলো নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল; গ্রন্থের সম্পাদক দীনেশচন্দ্র সেন যে এলাকাকে বলেছিলেন ‘পূর্ব মৈমনসিংহ’, সেই ‘পূর্ব মৈমনসিংহে’র কিশোরগঞ্জ আজ আর ময়মনসিংহেই থাকল না। অথচ নারী কবি চন্দ্রাবতী থেকে অনেক গাথাকারের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। টাঙ্গাইল আর কিশোরগঞ্জ জেলা দুটি মনে করে ময়মনসিংহ বিভাগের সঙ্গে থাকলে তাদের উন্নয়ন ও স্বার্থ ব্যাহত হবে। শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনার মানুষও যে ময়মনসিংহ বিভাগ জোরালোভাবে চেয়েছে, সে রকম দাবি চোখে পড়েনি। তবে ময়মনসিংহ জেলার মানুষ চেয়েছে।
প্রাচীন অঞ্চল ময়মনসিংহের ঋদ্ধ এলাকা ছিল নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর। ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ১৮৬৯ সালে পৌরসভা হয়। ১৮৮৭ সালে নেত্রকোনা পৌরসভা স্থাপিত হয়। নেত্রকোনায় ১৯৪৫ সালে সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জামালপুরে
>প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে কেন্দ্রমুখী উন্নয়ন শুরু করলে দেশের অষ্টম বিভাগ ময়মনসিংহের প্রত্যেক মানুষ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি জেলাগুলোর মধ্যে বৈষম্য কমবে
১৮৯৯ সালেই স্থাপিত হয় রেলপথ। অর্থাৎ পৌরসভা হিসেবে ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনার যাত্রাটি মোটামুটি একই সময়। উন্নয়নের ধারণাটি তখন সার্বিক ছিল, একপেশে ছিল না। সার্বিক ছিল বলে একই সঙ্গে অঞ্চলগুলো পরিবর্তনের বাতাস পেয়েছে। কিন্তু জেলাকরণের ফলে বাকি তিন জেলা থেকে ময়মনসিংহ এগিয়ে যায়। জামালপুর জেলা হয় ১৯৭৮ সালে, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলা হয় ১৯৮৪ সালে। জেলার দৌড়ে পিছিয়ে যাওয়ায় ময়মনসিংহ থেকে বাকি তিনটি জেলা উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ে। যদিও ময়মনসিংহ জেলার অংশ হিসেবে ময়মনসিংহের মতোই বা কাছাকাছি শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনার উন্নয়ন হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।
আগে জেলা হওয়ার কারণে সব উন্নয়ন কেন্দ্রীভূত হয় ময়মনসিংহে। উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও যোগাযোগব্যবস্থার হালকে যদি বিবেচনা করা হয়, তবে দেখা যাবে, গত ৭০ বছরে ময়মনসিংহের ভাগ্যে যা জুটেছে, তার ১ শতাংশও জোটেনি বাকি শেরপুর-জামালপুর-নেত্রকোনার কপালে। যেমন, ময়মনসিংহে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মেডিকেল কলেজ, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, দুটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ (টিটি) কলেজ, একটি ক্যাডেট কলেজসহ বহু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনায় এ ধরনের কোনো উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়নি। উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলে উন্নয়ন সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোক সেখানে আসে।
আজ রাঙামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে কারণে, একই কারণে এই তিনটি জেলাতেও বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে পারত। ময়মনসিংহে গত ৭০ বছরে শিল্প খাতে যে সমৃদ্ধি ঘটেছে, শুধু জামালপুরে সামান্য একটু ছাড়া আর কোনো জেলায় এর ছিটেফোঁটাও লাগেনি। অথচ মেঘালয় সীমান্তবর্তী সমতল জেলা শেরপুরে পাথর প্রক্রিয়াকরণ শিল্প থেকে শুরু করে এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান সহজেই স্থাপিত হতে পারত। সমতল জেলা, কিন্তু শেরপুরে রেলপথ নেই। অথচ গাইবান্ধায় আছে, জামালপুরেও আছে। এই জেলায় রেলপথ স্থাপন করে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর মধ্যে আন্তসংযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং তা মেঘালয় সীমান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে ভারত থেকে কয়লা, পাথর ইত্যাদি সহজভাবে দেশে আনা যেতে পারে।
ময়মনসিংহ বিভাগ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে নয় সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি গঠিত হয়, সেই কমিটি সরকারের কাছে পাঁচ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করে। তাঁরা কী বলেছেন, তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের বক্তব্য: বিভাগের উন্নয়ন কেন্দ্র নয়, প্রান্ত থেকে শুরু করতে হবে। ১০০ বছর আগেও ময়মনসিংহের কেন্দ্র ও প্রান্তের যে উন্নয়ন-সমতা ছিল, গত ৭০ বছরে তা ভেঙে গেছে। এই সমতা পুনঃস্থাপন জরুরি।
বিভাগ হওয়ার আগেভাগেই ভালুকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারের কৃষিজমিগুলো ধনীদের হাতে চলে গেছে। একরের পর একর কেউ চিহ্ন দিয়ে, কেউ চিহ্ন না দিয়ে জমি কিনে স্রেফ ফেলে রেখেছে। কিনেছে হয়তো পাঁচ হাজার করে, বেচবে ৫০ লাখ। দাম বাড়ানোর জন্য তকমা পাল্টানো চাই। তারা বলবে, বিভাগীয় শহর বা সিটি করপোরেশন, দাম তো হবেই। কিন্তু ভূমিহীন কৃষকেরা, কোথায় তাঁরা! কেউ তার খোঁজ রাখবে না। যদি তা-ই হয়, বিভাগের নামে, উন্নয়নের নামে সবকিছু ময়মনসিংহকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, তবে আমাদের ধারণা, আগামী ১০ বছরের মধ্যে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা জেলা তিনটি আরও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়বে, এখানের মানুষগুলো আলোহীন ঘরের বাসিন্দার মতো থাকবে। তাতে ঢাকা ও ময়মনসিংহের রাস্তার দুই ধারে আলো হয়তো জ্বলবে, কিন্তু আঁধার নেমে আসবে ওই তিন জেলায়।
এসব বিবেচনায় নিয়ে কিছু প্রস্তাব করতে চাই। ১.শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর জেলার সুবিধাজনক স্থানে অন্তত দুটি পাবলিক (সরকারি) বিশ্ববিদ্যালয় অতি দ্রুত স্থাপন করতে হবে। (দেশের প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সরকারি সিদ্ধান্ত আছে।) ২. শেরপুর-মেঘালয় সীমান্তকে বাণিজ্যবান্ধব করে সেই অনুসারে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে। ৩. নেত্রকোনায় ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র করে তা সুনামগঞ্জের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। ৪. জামালপুরে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে। ৫. রেলপথবিহীন শেরপুরে রেল চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে এবং শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুরের মধ্যে সড়কপথ উন্নত করতে হবে। ৬. এই তিনটি জেলার সঙ্গে গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের যোগাযোগের পথ উন্নত করতে হবে।
প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে কেন্দ্রমুখী উন্নয়ন শুরু করলে দেশের অষ্টম বিভাগ ময়মনসিংহের প্রত্যেক মানুষ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি জেলাগুলোর মধ্যে বৈষম্য কমবে এবং ময়মনসিংহ মডেল বিভাগ হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
ড. সৌমিত্র শেখর: নজরুল-অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]