উদ্ভট উটের পিঠে ঢাকার সাত কলেজ
১৯৮২ সালে আমাদের এসএসসি লিখিত পরীক্ষার শেষ দিনে বন্দুকের জোরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন পতিত স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ। সেদিন বুঝিনি, এরশাদ আমাদের শিক্ষাজীবনকে কীভাবে বিলম্বিত, প্রলম্বিত করতে পারেন। টের পাই এইচএসসি পরীক্ষার পর যখন বুয়েটে ভর্তি হই, ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে। তারপর দীর্ঘ প্রায় ১৪ মাস পর আমাদের ব্যাচের বুয়েটের ক্লাস শুরু হয়। পুলিশ দিয়ে হল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, যখন-তখন সাইনে-ডাই করে দেওয়ার ফলে ১৯৮৮ সালের পরিবর্তে ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে আমার বুয়েটের স্নাতক জীবনের পরিসমাপ্তি হয়। সে সময় আমাদের সান্ত্বনা ছিল পতিত স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারা। আর দুঃখবোধ বেদনায় পর্যবসিত হয়নি, কারণ সারা দেশে সবারই কমবেশি এ রকম দুর্ভোগ সামলাতে হয়েছে।
এক লহমায় এসব কথা মনে পড়ল আমার সামনে বসা তিন তরুণ-তরুণীকে দেখে। ওদের দেখলেই বোঝা যায় ওদের চারপাশে কেবল হতাশা। তারুণ্যের স্বাভাবিক দীপ্তি ওদের মধ্যে নেই। তাকিয়ে থাকলে মনে হবে, ওরা বুঝি মরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে!
অনেকেই বুঝে ফেলেছেন ওরা তিনজন ‘ঢাকার সাত কলেজের’ শিক্ষার্থী। আমি ওদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম লেখার সময় কোটেশন মার্ক ব্যবহার করেছি। কারণ এই ক্যাটাগরির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই পৃথিবী কেন, এই দুনিয়ার (ইউনিভার্স) কোথাও নেই বলেই আমার বিশ্বাস। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমাতে ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। ওই সময় এসব কলেজে শিক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজারের মতো।
আমার সামনের তিনজনের মধ্যে বড় জন ইডেন কলেজের ছাত্রী। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছে সে। এই ৬ বছরে তার চার বছরের সম্মান কোর্স শেষ হয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে গেছে ৫ মাস আগে। তবে এখনো ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। ‘স্যার, আমার বন্ধুরা যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, তাদের মাস্টার্স পরীক্ষা সামনে। আর আমাদের অভিভাবক বিশ্ববিদ্যালয়, মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হয়েছিল, তারা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছে ৪ মাস আগে এবং বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্রটির মন আরও খারাপ। কারণ ও এখনো প্রথম বর্ষ শেষ করতে পারেনি। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বন্ধুরা এখন তৃতীয় বর্ষের শেষ দিকে চলে এসেছে। ‘শুধু তা-ই নয়, আমরা জানতাম আমাদের অনার্স পরীক্ষা চার ঘণ্টার। কিন্তু হলে গিয়ে জেনেছি পরীক্ষা হবে তিন ঘণ্টার।’
তৃতীয় জন অনার্সের শিক্ষার্থী নয়, ও পড়ছে ডিগ্রি পাস কোর্সে। ২০১৪-১৫ সালের ওই শিক্ষার্থী যখন দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করছে, তখন ঢাকার বাইরে তার বন্ধুদের তৃতীয় বর্ষের ফলাফল প্রকাশিত হয়ে গেছে।
‘এভাবে আমাদের জীবন থেকে এতগুলো বছর চলে যাচ্ছে। আমাদের অপরাধ কী স্যার, বলতে পারেন?’
না, আমি বলতে পারিনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পর যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে অনিচ্ছুক, এই সাত কলেজ তাদের পছন্দের প্রথম সারিতেই ছিল। কেবল রাজধানী ঢাকাতে বলে নয়, বরং একসময়ে এই কলেজের শিক্ষার্থী ও স্নাতকেরা দাপিয়ে বেড়িয়েছে বাংলাদেশকে। সেই কারণেই হয়তো আমার সামনে বসা তিনজন তাদের পছন্দের তালিকায় এই কলেজগুলোকে এগিয়ে রেখেছিল এবং এখন সে জন্য মনের দুঃখে বনবাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
৮ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়েছে, এই সাত কলেজের প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থীর দেখভাল করা, তাদের পরীক্ষা-ফলাফল নিয়মিত করা—এসবের ন্যূনতম সক্ষমতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শিক্ষার্থী পড়ে না। কিন্তু সাত কলেজের এতসংখ্যক শিক্ষার্থীর দিকে মনোযোগ দেওয়া, তাদের একাডেমিক বিষয় অনুসরণ করা কিংবা তাদেরকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য না লোকবল, না অবকাঠামো—কিছুই কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে?
আমার মনে হয় না। জুন মাসে একজন শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার আগের ও পরের গ্রেড শিটের ছবি দিয়েছে। দেখা গেছে, শিক্ষার্থী একটি বিষয়ে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিলেও তাকে সাতটি বিষয়েই অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে। অথচ আগের ফলাফলে সে ওই ছয় বিষয়ে পাস করেছিল। বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীর সব তথ্য যথাযথভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর হয়নি। কিন্তু এ দায়ভার কার? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, নাকি শিক্ষার্থীর? সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ওই শিক্ষার্থী নিজেই ওই দুর্ভোগের জন্য দায়ী।
গত সোয়া দুই বছরে সাতটি কলেজের উদ্ভট সব সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়ার খবর আমার জানা নেই। আমার শুধু জানা আছে, গত বছর বিষয়টা সামনে আনার খেসারত দিয়েছেন শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান, তাঁর নিজের চোখ হারিয়ে!
এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের এ দুঃখ-হতাশা নিয়ে পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনে এসেছে। তাদের দাবি—পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ত্রুটিমুক্ত ফল প্রকাশসহ একই বর্ষের সব বিভাগের ফল একত্রে প্রকাশ, গণহারে অকৃতকার্য হওয়ার কারণ প্রকাশ ও খাতা পুনর্মূল্যায়ন, সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, প্রতিটি বিভাগে মাসে দুই দিন করে অধিভুক্ত সাত কলেজে মোট ১৪ দিন ঢাবি শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়া এবং সেশনজট নিরসনে একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশসহ ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু। ৮ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আশ্বাস পেয়ে তারা আবার পড়ার টেবিলে ফেরত গেছে।
কিন্তু তাদের দাবিদাওয়া পূরণ হবে তো? নাকি আশ্বাস আশ্বাসই থেকে যাবে?
মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান