নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের ১২তম নির্বাচন কমিশন বিদায় নিয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিদায়কালে নূরুল হুদা পাঁচ বছরের নিজের কর্মকাণ্ডকে সফল এবং কোনো কর্মকাণ্ডের জন্যই বিব্রত নন বলে বক্তব্য দিয়েছেন। তবে তাঁর সঙ্গে সহযোগী বাকি চার কমিশনার একমত ছিলেন বলে মনে হয় না, বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি প্রায়ই ভিন্নমত পোষণ করে আসছিলেন। বিদায়ী নির্বাচন কখনোই একটি সুসংগঠিত কমিশন হিসেবে কাজ করতে যেমন পারেনি, তেমনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে ১৯৯১ সালের পর থেকে যে সাতটি নির্বাচন কমিশন ছিল, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হিসেবে বিদায় নিয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।
এর আগের রকিব কমিশন একতরফা নির্বাচন এবং বিনা ভোটে অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য নির্বাচনের মাধ্যমে যে বদনাম কুড়িয়েছে, তার চেয়ে হুদা কমিশন আরও বিতর্কিত ও নিন্দিত হয়েছে বহু জায়গায় অনুষ্ঠিত ‘রাতের ভোটের’ অভিযোগ তদন্ত না করেই। অথচ এ নির্বাচনে বিএনপিসহ বহু দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। সুযোগ ছিল নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা ফেরানো। হুদা কমিশন, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কোনো অভিযোগের পাত্তাই দেননি। মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারের বাংলা ভার্সনে অকপটে স্বীকার করেন যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বহু স্থানে রাতে ভোট হয়েছিল, যা তাৎক্ষণিক তদন্ত করলে বের হয়ে আসত। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে ৪২ জন গণমান্য নাগরিক অভিশংসনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনও করেছিলেন।
ব্যাপক বিতর্কের কারণে জনগণ কীভাবে এ কমিশনকে মূল্যায়ন করবে, তা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা ২০১৪ সালের নির্বাচনকে যেমন ‘ব্যর্থ নির্বাচন’ আখ্যা দিয়েছিলেন, তেমনি ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছেন। অপর দিকে সপ্তম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এসব সহিংসতাকে পাত্তা না দিয়ে কমিশন দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড এবং পরপর দুটি জাতীয় ব্যর্থ নির্বাচন রাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংগঠন নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তলানিতে নিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কমিশন জনগণ ও ভোটারদের আস্থা পুরোপুরি হারিয়েছে। কোনো নির্বাচন কমিশনের অবস্থা যদি এমন বিতর্কিত হয়, তার গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নির্বাচন কমিশনের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর। অনেক কর্মকর্তা নিজেদের পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জনবল এবং অবকাঠামোর দিক থেকে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ কমিশন। কাজেই এই বৃহৎ সচিবালয়ের ৯৫ শতাংশ নির্বাচন কমিশনের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী।
গত দুটি নির্বাচন যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে উজ্জ্বল করেনি এবং বাংলাদেশে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেনি, তা পরিষ্কার। এ অবস্থায় যখন বিশ্বে উদার গণতন্ত্রের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের আগামী নির্বাচন অতীতের একই ধারা বজায় থাকলে বাংলাদেশের উন্নতির ওপর বড় আঘাত আসবে।
ওপরের আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো সামনে যে নতুন ১৩তম নির্বাচন কমিশন হতে যাচ্ছে, তাদের সামনে যে পাহাড়সমান চ্যালেঞ্জ আছে তা তুলে ধরতে। নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জনগণ ও ভোটারদের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। নিজেদের সততা ও আন্তরিকতার বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করা। কাজটি খুব কঠিন। জনগণের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রথমে আস্থায় নিতে হবে। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, যারা আইন প্রণয়ন থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন পর্যন্ত বিরোধিতা করেছে। আন্তরিকতা প্রদর্শনের সবচেয়ে উপযুক্ত পথ হলো সামনে যেসব স্থানীয় সরকার নির্বাচন এখনো বাকি রয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া।
শুধু বিদায়ী কমিশনই নয়, এর আগেও কয়েকটি কমিশন অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগেছে। বিদায়ী কমিশন সে ক্ষেত্রে অনন্য উদাহরণ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলও ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। স্মরণযোগ্য যে নির্বাচন কমিশন আমলাতান্ত্রিক আদলে পরিচালিত হয় না। এখানে মূল কাজ এবং সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিতে হয় এবং এ ক্ষেত্রে সবার ভোটেরই সমান মূল্য। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওপর সচিবালয় পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকলেও কমিটি মিটিংয়ে তিনি চেয়ারম্যান মাত্র, কোনো ভেটো ব্যবস্থা নেই। কাজেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি সবাইকে নিয়ে চলতে না পারেন, তবে কমিশন ব্যর্থ হতে বাধ্য।
আমাদের সংবিধান ও আইন মোতাবেক নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পাঁচ বছর। এখানে প্রায় সব নির্বাচনই একবার অনুষ্ঠিত করার সুযোগ আসে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক দিনে করার রেওয়াজ রয়েছে। আর প্রায় দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন। যেখানে প্রায় ১৭ লাখ জনবল এবং কয়েক হাজার উপকরণের প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে প্রশিক্ষণের, আইনের পর্যালোচনা, প্রয়োজনে সংশোধন ইত্যাদি। অপর দিকে রাজনৈতিক বিভাজন কমানোর প্রচেষ্টা এবং সব দলকে নির্বাচনে আনার প্রচেষ্টা হবে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ।
এই স্বল্প পরিসরে অন্য চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। নবনিযুক্ত কমিশনকে মনে রাখতে হবে, তাঁরা যে দায়িত্ব নিয়েছেন, সেখানে শুধু নিজেদের ভাবমূর্তি নয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে তাঁদের কারণে বিতর্কিত অথবা ব্যর্থ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অতীতেও নেয়নি। দায়দায়িত্ব বর্তাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর। তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে যেমনটি গত দুটি নির্বাচনে আলোচিত হয়েছে। ওই দুটি নির্বাচন সর্বাত্মকভাবে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক ও অধ্যাপক এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞ পিপ্পা নরিসের বিখ্যাত গবেষণাকর্ম হোয়াই ইলেকশন ফেইলস বইয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা চ্যাপ্টারে ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার কারণ এবং দায়িত্ব বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। আমাদের গত দুটি নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার ওপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা হয়।
সবশেষে বলতে চাই আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা যে ভেঙে পড়েছে, সেটা নিয়ে বিতর্কের জায়গা অনেক কম। গত দুটি নির্বাচন যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে উজ্জ্বল করেনি এবং বাংলাদেশে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেনি, তা পরিষ্কার। এ অবস্থায় যখন বিশ্বে উদার গণতন্ত্রের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের আগামী নির্বাচন অতীতের একই ধারা বজায় থাকলে বাংলাদেশের উন্নতির ওপর বড় আঘাত আসবে। কাজেই নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই যাতে ব্যর্থ না হয়, সে লক্ষ্যে চ্যালেঞ্জগুলোকে নির্ধারণ করে এগোতে হবে। আশা করি, নবনিযুক্ত কমিশন জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)