দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তথা উচ্চশিক্ষায় সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সুস্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে মাঝেমধ্যে জাতীয় দৈনিকের নেতিবাচক শিরোনাম শিক্ষিত সমাজকে বিচলিত করে। অন্যদিকে সুযোগসন্ধানী শ্রেণি ফায়দা লোটার চেষ্টায় থাকে। আসল সত্য হলো, গুটিকয়েক মানুষের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড পুরো শিক্ষক সমাজকে হেয় করছে, প্রশ্নবিদ্ধ করছে শিক্ষাব্যবস্থাকে। ‘কাঠের চশমা’ পরা লোকেরা এমন অবস্থার জন্য সব ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরই দায়ী করে থাকে।
আজকের অবক্ষয়ের জন্য নিশ্চিতভাবে শিক্ষকেরা এককভাবে দায়ী নয়। রাষ্ট্রের ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাঠামোতেই রয়েছে হরেক রকমের বৈষম্য ও বৈপরীত্য। দীর্ঘদিন এগুলো অনুশীলনের ফসল হচ্ছে শিক্ষামানের ক্রমাবনতি। এর ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে তলানিতে দেশ। যদিও অনেকে শিক্ষকতা ‘মহান’ পেশা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁরাও রক্ত-মাংসের মানুষ। অসমতা ও বৈষম্য যুগে যুগে সমাজে বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দিয়েছে বা এখনো দিচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম কিন্তু চরম বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণেই হয়েছিল। তাই উচ্চশিক্ষায় বৈষম্যগুলোর ধরন জানা জরুরি। না হলে শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগিতার উদ্যোগ বা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরির প্রচেষ্টা হতে পারে অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্যগুলো কিছু রাষ্ট্র সৃষ্ট (ঐতিহাসিক) আর কিছু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ‘তথাকথিতদের’ দ্বারা তৈরি, যা অবশ্যই দলীয় রাজনীতির মোড়কে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। রাষ্ট্র কর্তৃক বৈষম্যগুলো শিক্ষকদের মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কেননা রাষ্ট্রযন্ত্রে তার প্রতিনিধিত্ব যৎসামান্য। যেমন একজন শিক্ষকের সঙ্গে সমমানের সরকারি কর্মকর্তার সুবিধাদি এবং শান শওকত তুলনায় দেখা যায় বেতন-ভাতা একই থাকলেও সরকারি কর্তার সুবিধাদি অনেক। হালে তা বহুগুণ বেড়েছে। অবশ্য তাঁদের সুবিধাদি অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রে সংজ্ঞায়িত। আবার রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো কখনো বিদ্যমান অসমতাকে প্রসারিত করে। ফলে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে মানসিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে ছয়টি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে সরকারি হিসাব কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা ফেরত দিতে বলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি কিন্তু বলছে, সবকিছু আইনি কাঠামোর মধ্যেই হয়েছে। আরও জানা যায়, বর্তমানে একজন শিক্ষক মাসিক ৫০০-৭০০ টাকা গবেষণা ভাতা পান, যা রহিত করার সুপারিশ রয়েছে। যদিও পরিমাণের দিক থেকে খুবই নগণ্য, তথাপি এই ভাতা বহু বছর ধরেই প্রচলিত। হঠাৎ করেই সরকারি হিসাব কমিটি কেন এ ব্যাপারে আপত্তি তুলল, তা বোধগম্য নয়। তবে তারা বলছে, খাতটি জাতীয় বেতন স্কেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ থেকে কি প্রতীয়মান হয় না যে দেশে সুস্পষ্ট নীতির বড্ড অভাব। যাক, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে প্রকৃত গবেষকদের গবেষণা ভাতা বৃদ্ধি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপরিহার্য।
অন্যদিকে একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের অব্যবহিত পরেই, হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হন। একটি বিভাগে নিয়মিত পাঠদান ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার কাজ রয়েছে। যেমন পরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট, অন্য বিভাগে সহায়ক বা সান্ধ্য কোর্সে পড়ানো। প্রতিটি খাতে অর্থ জড়িত, মানে কেউ অন্তত একটির সঙ্গে যুক্ত হলে কিছু আর্থিক সুবিধা পায়। যেহেতু বিভাগীয় কার্যক্রমে বয়োজ্যেষ্ঠদের মতামত শিরোধার্য, নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকেই উপরিউক্ত খাতগুলোতে থাকেন উপেক্ষিত।
শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষমতার অনুশীলন বা কর্তৃত্বপরায়ণতার লাগাম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার একটি ধারণা পাওয়া যাবে জ্ঞানসূচকে দেশের অবস্থান থেকে। এমন অবস্থা রোধ করা না গেলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে।
আর নিয়োগপ্রাপ্ত যদি ‘দলান্ধ’ না হন, তবে দুর্গতি সীমাহীন। আবার ‘রাজনৈতিক’ ঘরানার না হলে প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের দ্বারা বৈষম্যের শিকার নিয়মিত ঘটনা। আবাসিক হলে হাউস টিউটর পদ পেলে পদোন্নতিতে কিছু রেয়াত পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে ‘দলকানা’ না হলে তীর্থের কাক হয়েই থাকতে হয়। কারও পছন্দ হোক বা না হোক পদ্ধতিগত দুর্বলতা, নিয়মের অস্পষ্টতা, যথোপযুক্ত নিয়মের অভাব এবং কর্তাদের কায়েমি স্বার্থে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অনেকেই নিজেকে রাজনীতির ‘বিস্কুট দৌড়ে’ নিয়োজিত করতে বাধ্য হন। দৌড়ে জয়ী হলে রাজা, না হলে প্রজা।
একটা উদাহরণ দিই। একজন পরিচিত শিক্ষক হয়ে মনস্থির করেছিলেন শিক্ষা/গবেষণা করবেন, কোনোভাবেই রাজনীতি করবেন না। বছর দুই না ঘুরতেই রাতারাতি ‘রাজনীতিবিদ’ বনে যান তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদ্যমান বৈষম্য সইতে না পেরে ‘তথাকথিতদের’ দলে ভেড়েন। ফলে তিনি যেমন নিজ বিভাগে সমাদৃত হতে শুরু করেন, তেমনি সংশ্লিষ্ট অঙ্গনে পরিণত হন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিতে। প্রজার ভাগ্য হলে অনেকের কার্যক্রমে আসে নির্লিপ্ততা অথবা শেষ পর্যন্ত অন্যত্র মনোনিবেশ বা দেশত্যাগ। ফলে দেশ ও সমাজ হয় ক্ষতিগ্রস্ত। নীতিনির্ধারকেরা কি কখনো অনুধাবন করেছেন এসব বৈষম্যের কথা? বলা বাহুল্য, এগুলোর বেশির ভাগ কিন্তু আমাদেরই তৈরি। কর্তার ইচ্ছায় ব্যক্তিবিশেষে চলে নিয়মনীতির ‘অপ’-প্রয়োগ। কেউ উপলব্ধি করেন না উপদলে বা ছোট দলে বিভক্তি কখনো প্রতিষ্ঠান বা নিজস্ব সম্প্রদায়ের জন্য সুখকর না। যখন সংবিৎ ফেরে, তখন সব শেষ!
সম্প্রতি পত্রিকায় জানতে পারি, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়মকানুন অনেকাংশে শিক্ষকদের দ্বারা তৈরি, কথাটা পুরোপুরি সঠিক না। কেননা, প্রতিষ্ঠানগুলো চলে রাষ্ট্র কর্তৃক তৈরি নির্দিষ্ট অধ্যাদেশের আলোকে আর কিছু নিয়মের পরিবর্তন/পরিমার্জন প্রয়োজন হলে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ সংস্থা সিন্ডিকেট দ্বারা অনুমোদিত হয়, যেখানে সরকারি কর্তাদের প্রতিনিধিত্বও রয়েছে। আর স্বায়ত্তশাসন বহু আগেই গত হয়েছে, রয়েছে শুধু খোলস। আর এই খোলসকে সুদৃঢ় করার জন্য ‘কোটারি প্রথা’ এখন সর্বজনবিদিত।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৭-এর মধ্যে ধনকুবেরের সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। মানে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আর্থসামাজিক বৈষম্য। অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও রয়েছে প্রবল বৈষম্য, যা অনেকের চিন্তায় কখনো আসেনি। আপাতদৃষ্টিতে এসব বৈষম্য দূর করার চেষ্টা কম, কিন্তু প্রসারের কমতি নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষমতার অনুশীলন বা কর্তৃত্বপরায়ণতার লাগাম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার একটি ধারণা পাওয়া যাবে জ্ঞানসূচকে দেশের অবস্থান থেকে। এমন অবস্থা রোধ করা না গেলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে। আবার বিজ্ঞানচর্চার পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার পরনির্ভরতা যেমন দূর হবে না, তেমনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সনদনির্ভর সংস্থা হিসেবেই টিকে থাকতে হবে।
আশরাফ দেওয়ান অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস-এর গবেষক।