আমাদের ইতিহাসের যুগান্তকারী কিছু ঘটনাকে এবং সামাজিক জীবনের অনেক করণীয় বিষয়কে আমরা পার্বণিক উদ্যাপন অথবা কৃত্যের ছকে ফেলে মাস বা দিন এলে সেগুলো নিয়ে নড়েচড়ে বসি, মাস-দিনটা পার হলে আবার ভুলেও যাই। বিশ্ব সাদাছড়ি দিবসে আমরা দৃষ্টিবঞ্চিতদের নিয়ে ভাবি, বাকি দিনগুলোতে সাদাছড়ি হাতে পথে নামা প্রবীণ মানুষটাকে আমরা এতটুকু ছাড় দিই না, বরং তাঁর গায়ের ওপর গাড়ি তুলে দিই। মাতৃভাষাকেও আমরা তেমনি একটি মাসের পরিসরে ফেলে দিয়ে, দিন-তারিখ মেপে, তা নিয়ে আমাদের আবেগ-ভালোবাসা-উদ্বেগ-অহমিকা সবই উজাড় করে দিই। তারপর দরজায় মার্চ এসে দাঁড়ালে আমরা ‘স্বাধীনতার মাস’ নামের খোপটাতে ঢুকে পড়ে স্বাধীনতা নিয়ে কথার মিছিল শুরু করি, মাতৃভাষাকে বেমালুম ভুলে যাই।
ফেব্রুয়ারির এক সপ্তাহ আগে থেকেই আমার কাছে অনুরোধ আসে, মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা কেন দেওয়া হচ্ছে না, কেন সরকার এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না, যেন সব দায় সরকারের—তা নিয়ে লিখতে, আমি যেহেতু উচ্চশিক্ষার মাঠটিতে প্রায় পাঁচ দশক ঘুরেফিরে কাটিয়ে দিলাম। মাঠটি অবশ্য ক্রমাগত বিবর্ণ হচ্ছে, ঘাস সবুজ হারাচ্ছে, এর বিস্তৃতি বেড়েছে, কিন্তু এর দেখাশোনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের সম্পদ এতটাই সীমিত যে নিয়মিত জলসিঞ্চনের কাজটিও তাঁরা করতে পারছেন না। তবে সে আরেক গল্প, আরেক দিবসের জন্য তা তোলা থাক।
আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় মাতৃভাষায় কি উচ্চশিক্ষা দেওয়া ও গ্রহণ করা সম্ভব? আমি বলি, অবশ্যই সম্ভব। আমার উত্তরটা এখানেই শেষ হলে আমার শ্রোতাদের মতো আমিও আনন্দিত এবং তৃপ্ত হতাম। কিন্তু ‘সম্ভব’ কথাটি একটা দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের শুরুটা মাত্র, একটা জটিল বিতর্কের অবতারণা মাত্র। কারণ, এরপরই প্রশ্ন আসবে, কার মাতৃভাষা? যদি বাংলাদেশিদের জন্য সেটি হয় বাংলা, তাহলে আমরা তো ফের সেই উপনিবেশি পথেই হাঁটব। সংখ্যার জোরে ওই কুড়ি লাখের ওপর আমাদের আধিপত্য চাপিয়ে দিলে উচ্চশিক্ষা তাহলে আমাদের কী শেখাবে?
আমরা ধরে নিলাম, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষাতেও আমরা উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করে ফেলব। কারণ, যে পথে এগোলে বাংলা ভাষাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করা যায়, সে পথে হাঁটলে যেকোনো ভাষাকেই ওই অবস্থানে নিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু পথটা, যাকে বলে কাঁটা বিছানো। কাঁটাগুলোকে সরাতে সবাইকে পথে নামতে হবে। কাজটা সহজ নয় মোটেও, কিন্তু অসম্ভব তো নয়। যদি হতো, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, জাপানসহ অনেক দেশ সে কাজটি করে দেখাতে পারত না।
ওই সক্ষম দেশগুলোর পথে এগোতে হলে প্রথমেই মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের আবেগ, একদেশদর্শিতা, পার্বণিকতা এবং গ্যালারির জন্য খেলার প্রবণতা থেকে বেরোতে হবে। এবং যুক্তি, উপযুক্ততা এবং প্রায়োগিকতার কাচ দিয়ে বিষয়টা দেখে, মেপে মেপে পা ফেলতে হবে। আবেগটা আমরা বুঝি। মাতৃভাষা নিয়ে আবেগ কার নেই? যাদের নেই, যারা মাতৃভাষাকে হিংসার চোখে দেখে, সেসব কাহার জন্ম, তা নির্ণয় করা নিয়েই তো সমস্যায় পড়েছিলেন সপ্তদশ দশকের কবি আবদুল হাকিম। কিন্তু গ্যালারির জন্য খেলা? সেমিনারে, টক শোতে, বাংলা একাডেমির আলোচনা সভায় উচ্চশিক্ষা কেন মাতৃভাষায় দেওয়া হবে না, তা নিয়ে আমরা কতই না কথার ঝড় তুলি। তাতে দর্শক-শ্রোতার আবেগ মোচন হয়, কিন্তু যুক্তি তাতে প্রতিষ্ঠা হয় না। এই যুক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই আমরা তুলছি, কিন্তু সেগুলো শুনে সরকারের চোখ যায় কোষাগারের দিকে এবং কপালে ভাঁজ তুলে সরকার চোখ ফিরিয়েও নেয়।
যাঁরা বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করার জন্য আবেগ দেখান, তাঁদের অনেকেই ভুলে যান, উচ্চশিক্ষা একটি ভাষায় দেওয়া হলেও সে ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক ভাষা এবং একটি দেশের উচ্চশিক্ষা শুধু সে দেশে সীমাবদ্ধ থাকে না, তার সঙ্গে থাকে সারা বিশ্বের সংযুক্তি।
যে উদার বিনিয়োগ ছাড়া যুক্তিগুলোর মীমাংসা সম্ভব নয়, তার জোগান দিতে পারে শুধু সরকার। আর যাঁরা উদ্যোগী হলে সরকারও টাকার থলিটা খুলত, তাঁরা পিছিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন আবেগের। বাংলা নিয়ে আমাদের অহমিকার অন্তু নেই কিন্তু বিশ্বের সাত নাকি আট নম্বর বড় ভাষা বলেই বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে, ব্যাপারটা তো তা নয়। অধিকার তখনই অনিবার্যতায় রূপ নেবে, যখন বাংলা ভাষায় শিক্ষিতজনেরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা ক্ষেত্রে সক্রিয়তার স্বাক্ষর রাখবেন, এর শিল্প–সাহিত্য সম্পর্কে বিশ্ব জানবে, এ ভাষায় লেখা বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে গবেষণাভাষ্য বিশ্বের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, এ ভাষা যে বা যেসব দেশের প্রধান ভাষা, বিশ্ব অর্থনীতিতে তার একটা প্রভাব থাকবে এবং বিশ্বের জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রগুলোতে এ ভাষা প্রতিষ্ঠা পাবে। বাংলা এখনো ওই অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি, তবে ভবিষ্যতে যে পারবে, সেটি ধরে নিয়েই আমাদের ঘরের কাজগুলো সেরে নিতে হবে।
আমি দেখেছি যাঁরা বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করার জন্য আবেগ দেখান, তাঁদের অনেকেই ভুলে যান, উচ্চশিক্ষা একটি ভাষায় দেওয়া হলেও সে ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক ভাষা এবং একটি দেশের উচ্চশিক্ষা শুধু সে দেশে সীমাবদ্ধ থাকে না, তার সঙ্গে থাকে সারা বিশ্বের সংযুক্তি। অর্থাৎ মাতৃভাষা দৃষ্টির মাঝখানে থাকলেও দৃষ্টিটা পরিব্যাপ্ত থাকে অনেক দেশে, অনেক ঐতিহ্যে, অনেক দিগন্তে। মাতৃভাষাকে যদি আমরা আবেগ দিয়ে গ্রহণ না করে যুক্তি, চর্চা এবং এর নিরন্তর সমুন্নতির প্রত্যয় নিয়ে গ্রহণ করি, দেখা যাবে তাতে অনেক ভাষার সঙ্গে এর কথোপকথনটা নিশ্চিত হয়ে যাবে, এর উদারতা বাড়বে, বিশ্ব থেকে গ্রহণ করার মানসিকতাটা তখন একটা প্রস্তুতিপর্ব শেষ করে সক্রিয়তার পর্বে ঢুকে পড়বে এবং চিন্তা ও সৃষ্টির জায়গায় নতুন নতুন স্থাপনা তৈরির একটা উদ্যম এই ভাষাভাষীদের ভেতর তৈরি হবে। এর ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্যটা যেমন অর্জন করা যাবে, শিক্ষার সংস্কৃতিটাও তেমনি প্রকাশ্য হবে, আমাদের প্রতিদিনের চর্চায় ঢুকে পড়বে।
মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা দেওয়া এবং নেওয়া সম্ভব, যদি এর কয়েকটি আবশ্যকতাকে আমরা অপরিহার্য বিবেচনা করে আমাদের অভিনিবেশে রাখি এবং এ জন্য যা যা প্রয়োজন, সেসবের সমাবেশ ঘটাতে পারি। যেমন:
১. রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সদিচ্ছা এবং অঙ্গীকার।
২. প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান।
৩. একটি সুষ্ঠু কার্যক্রম এবং একটি স্থিতিস্থাপক, পর্যায়ক্রমিক পরিকল্পনা।
৪. পরিকল্পনায় নির্দেশিত সব ক্ষেত্রে উচ্চমানের ব্যবস্থাপনা এবং এর নিবিড় প্রত্যবেক্ষণ।
৫. সময়ান্তরে বাস্তবায়ন নিয়ে পর্যালোচনা, ভুল থেকে শেখা, চর্চাগুলো আরও উন্নত করা।
বাংলাকে (অথবা কোনো নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে) উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করতে হলে সব পর্যায়ে সদিচ্ছা এবং অঙ্গীকার থাকার বিষয়টা। যদি সমাজের একটি অংশ এর বিরোধিতায় নামে অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ লক্ষ্য গ্রহণ না করে, তাহলে কাজটা বাধাগ্রস্ত হবে
এই ছক আপাতদৃষ্টিতে নিরুৎসাহিত করার মতো, কিন্তু এর বিকল্প হচ্ছে অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে ছুড়ে এগোনো। আমি নিশ্চিত, আমরা যদি কোমর বেঁধে কাজে নামি, তাহলে আরও উন্নত ছক তৈরি হবে, যাদের কার্যকারিতা নিশ্চয়ই হবে অনেক বেশি। কিন্তু মোটাদাগে কয়েকটি বিষয় ঘুরেফিরে প্রতিটি ছকেই থাকবে। যেমন বাংলাকে (অথবা কোনো নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে) উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করতে হলে সব পর্যায়ে সদিচ্ছা এবং অঙ্গীকার থাকার বিষয়টা। যদি সমাজের একটি অংশ এর বিরোধিতায় নামে অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ লক্ষ্য গ্রহণ না করে, তাহলে কাজটা বাধাগ্রস্ত হবে। যদি শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বর্তমানে জিডিপির যে ২ শতাংশের ধারেকাছে আছে, তা আগামী ছয়–সাত বছরে অন্তত ৪ শতাংশে না পৌঁছায়, তাহলে কোনো পরিকল্পনাই এগোবে না। পরিকল্পনাটা হতে হবে নতুন এক শিক্ষানীতির আলোকে এবং এটি সাজাতে হবে পনেরো-কুড়ি বছরের সময়ক্রম হিসাবে এনে। এই শিক্ষানীতিতে একটি ভাষানীতি থাকবে, যাতে মাতৃভাষা শিক্ষায় উচ্চমানের পাঠক্রম, অংশগ্রহণমূলক শিক্ষণ পদ্ধতি, মেধাবী শিক্ষক ও সহায়ক নানা কাঠামো (যেমন গ্রন্থাগার, বই পড়ার ব্যাপক কার্যক্রম) সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কার্যপ্রণালি থাকবে।
শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক স্তর থেকেই (যার ব্যাপ্তি হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) ইংরেজিকে গুরুত্ব দিয়ে পড়াতে হবে। ইংরেজি আমাদের ভালোভাবে শিখতে হবে, তা না হলে উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার প্রচলন কার্যকর হবে না। কথাটি একটু পরিষ্কার করে বলা যাক। উচ্চশিক্ষায় সব বিষয়ে আমাদের অসংখ্য পাঠ্যবই লাগবে এবং এগুলোর সিংহভাগ হবে অনূদিত, প্রধানত ইংরেজি থেকে। অনুবাদ নিয়ে যাঁরাই কাজ করেছেন, তাঁরা জানেন মূলত উদ্দিষ্ট ভাষায় সমান এবং উঁচু স্তরের দক্ষতা না থাকলে অনুবাদ দুর্বল হয়, যা পাঠ্যবইয়ের ক্ষেত্রে হতে পারে বিপজ্জনক। এই বিপুলসংখ্যক দক্ষ অনুবাদক তৈরি করতে হলে শিক্ষার্থীদের ভালো ইংরেজি শেখানোর কোনো বিকল্প নেই। এই উদ্যোগ হবে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। সবাই ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ হলে আমাদের এই লাভ হবে যে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতার যেকোনো ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে যাব। তখন বাংলা সাহিত্য ইংরেজিতে অনূদিত হবে, বাংলাদেশের গবেষণা দ্রুত বিশ্বের কাছে পৌঁছাবে, আন্তর্জাতিক যেকোনো দেনদরবারে আমরা স্বস্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারব। আর যে ভয়টা অনেকে করেন, ইংরেজির জোয়ারে বাংলা ভেসে যাবে, তা অমূলক প্রমাণিত হবে, যখন শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষার প্রকৃত শক্তিটা, যা থেকে এখন তারা বঞ্চিত, তাদের ভেতর ধারণ করতে পারবে এবং ইংরেজিকে সুবিধাভোগের ও কৌলিন্য লাভের ভাষা হিসেবে না দেখে বিশ্বের সঙ্গে, তার নানা সংস্কৃতি ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের একটা মাধ্যম হিসেবে দেখবে।
উচ্চশিক্ষায় যদি মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা বিশ্বের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই, তাহলে ইংরেজিসহ একটি বহুভাষিক কাঠামো আমাদের তৈরি করে নিতে হবে। তাহলে এক–দুই প্রজন্ম পর অনুবাদের কাজটা ঘুরে যাবে, অর্থাৎ বাংলার জ্ঞানকে আমরা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে শুরু করব।
এখন যেভাবে মাতৃভাষাশিক্ষা চলছে, তাতেই উচ্চশিক্ষা দেওয়া যাবে, যদি এ রকম আমরা ভাবি, তাহলে আমরা যে তিমিরে আছি, সেই তিমিরেই থেকে যাব। ভেবে দেখুন, বাংলা একাডেমিতেই আমরা একটা অনুবাদ সেল এখনো করতে পারিনি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা না-ই বা বললাম।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ