যে দেশের মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে, তারা তাদের নিজেদের ইতিহাস জানে। তাদের ইতিহাস একসময় ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল; তা যেমন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, তাদের নতুন করে ইতিহাস শেখানোর চেষ্টাও সফল হবে না।
এ দেশবাসীর এমনই নিয়তি যে এই শতাব্দীর প্রথম ছয় বছর তঁাকে এমন শাসনের অধীনে কাটাতে হয়েছে, যাদের কাছে দুনিয়াতে স্থানের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য এবং কালের মধ্যে মধ্যযুগ শুধু প্রিয়। জগতে যে আরও আলোকিত জায়গা ও যুগ ছিল, তার মূল্য ছিল না তাঁদের কাছে। ক্ষমতা হারিয়ে এখন তাঁরা কেউ হুজুরাখানায় নিরিবিলি সময় কাটাচ্ছেন, কেউ কোর্ট-কাছারিতে দৌড়াচ্ছেন।
আরেক দল সরকারে থাকুক না থাকুক, তারা দেশের মানুষকে ইতিহাস তালিম দেয়। সে ইতিহাসের শুরুও প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে নয়। প্রস্তরযুগ থেকে নয়। অশোক, বিম্বিসার বা আকবরের সময় থেকেও নয়—জিন্নাহর সময় থেকে ইয়াহিয়ার অতি প্রশস্ত সময় পর্যন্ত, যার মেয়াদ ২৪ বছর ৪ মাস ২ দিন। মহাকালের অতলগহ্বরে কত যে হাজারো ২৪ বছর ৪ মাস ২ দিন হারিয়ে গেছে, তার হিসাব একমাত্র এই মহাজগতের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
এই জগতে বহু বিষয় আছে শেখার। গণিত, নৃবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল, ভূতত্ত্ব—আরও কত-কী। বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্রে ভূতত্ত্ব পড়া খুব জরুরি। কারণ, কোথায় কোন জনপদে বাড়িঘরের মাটির তলায় কয়লা বা গ্যাস আছে, সে-সম্পর্কে জ্ঞান থাকা খুব প্রয়োজন। ভূগোল ও ভূতত্ত্ব পাঠ আরও বেশি জরুরি এ জন্য যে দেশের কোথায় কোন বনভূমির কী গুরুত্ব, যা ধ্বংস হলে জাতির কতটা ক্ষতি হবে, তা বোঝার জন্য ওই সব বিষয় অনুশীলন আবশ্যক। কিন্তু এখন দিনরাত শুধু ইতিহাসের টিউটোরিয়াল ক্লাস হচ্ছে। তা হচ্ছে রাস্তার মধ্যে নর-নারীবন্ধনে, গাছতলায়, হলঘরে এবং জনসভায়। একসময় দিনিয়াতের এস্তেমালও হতো ওইভাবে। তাঁরা ক্ষমতা থেকে চলে গেলেও ধর্ম হেফাজত করার অযুত মানুষ এ মাটিতে রয়ে গেছে। কখন যে আবার জাতীয় ফুলের চত্বর ঘিরে কোন বিষয় নিয়ে আওয়াজ ওঠে, তার নিশ্চয়তা নেই।
যে দেশের স্বাধীনতা টেবিলে বসে দুই-তিন পক্ষ চুক্তি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বা হ্যান্ডশেকের দ্বারা অর্জিত হয়নি, স্বাধীনতা এসেছে লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে, অগণিত নারীর সম্ভ্রমের মূল্যে, সেই দেশের কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের বেদনা ও শোকে ম্রিয়মাণ থাকার কথা অন্তত এক শতাব্দী। সে দেশের মানুষ আলতু-ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করবে—তা ভাবা যায় না এবং তা করা একেবারেই উচিত নয়।
শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, কিন্তু একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠন অতি কঠিন সাংগঠনিক ব্যাপার। তা শুধু সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি দলের কর্মীদের দ্বারা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন হাজারো মানুষের বিচিত্র উদ্যোগ। সেই মানুষ একই রাজনীতি ও নীতি-আদর্শে বিশ্বাস করবে, তা নয়। বৈচিত্র্যের মধ্যেই সমাজ বিকশিত হয়। যে সমাজের মানুষ সবাই একই কথা ভাবে, এক সুরে কথা বলে, সেই সমাজ মৃত সমাজ। যদি মৃত না-ও হয়, সে সমাজ নিশ্চেতন সমাজ। নিশ্চেতন মানুষের যেমন বাঁচা-মরা একই কথা, চেতনাহীন সমাজও তা-ই। সে বন্ধ্যা। তার পক্ষে কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
কোনো জাতির সংস্কৃতি অতি সূক্ষ্ম ব্যাপার। গান-বাজনা, প্রদর্শনী, খেলাধুলা ইত্যাদি সংস্কৃতির অংশ, কিন্তু শুধু ওগুলোর মধ্যেই সংস্কৃতি নেই। আনন্দ-ফুর্তি খুব প্রয়োজন, কিন্তু জ্ঞানচর্চা আরও বেশি প্রয়োজন। জ্ঞানচর্চার জন্য শান্ত পরিবেশ দরকার। কোনো প্রজন্মের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিতরা যদি ডিগ্রি নিয়েই শুধু চাকরি ও অর্থ-উপার্জনের পেছনে ছোটে, জাতি গঠনে কোনো ভূমিকাই না রাখে, তাহলে সে জাতির ভবিষ্যৎ থাকে না। মেধাবীরা যদি শুধু বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করাকেই জীবনের ধ্রুবতারা মনে করে; গাড়ি পাবে, ফ্ল্যাট কিনবে অভিজাত এলাকায়—এসবই হয় তাদের লক্ষ্য, তাহলে তাদের থেকে জাতি কিছু পায় না।
আজ একদিকে বাঙালি জাতির একটি গা-ছাড়া ভাব, যার সুযোগে গণবিরোধী কাজ খুব সহজেই করা যায়, অন্যদিকে কত রকমের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, কত কিছুর প্রদর্শনী বা সাংস্কৃতিক কনসার্ট শুধু নয়, রিহ্যাব মেলা, আয়কর মেলা, চাকরির জন্য ওয়াক-ইন-ইন্টারভিউ প্রভৃতি। এতে ওপর থেকে দেখলে মনে হবে সমাজটা আধুনিক ও সংস্কৃতিমান হয়ে উঠেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়; সত্যের সাধনা ও গভীর জ্ঞানচর্চা ছাড়া কোনো জাতি সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারে না।
রাজনীতি বিরাট ব্যাপার, জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসও অতি গুরুতর জিনিস। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি ওই বিরাট ও গুরুতর ব্যাপার নিয়ে প্রতিদিন ব্যস্ত থাকে, তাহলে ছোট ছোট ভালো জিনিস করার অবকাশ পায় না। জাপানি সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে স্বাধীন হতে হয়েছে কোরীয়দের। যেমন আমরা লড়েছি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। কোরীয় নারীরাও আমাদের নারীদের মতো যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বাধীনতার পর কোরীয়রা দেশ গড়ার কাজ শুরু করে বড় বড় কথা দিয়ে নয়, পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মাধ্যমে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সাফসুতরো রাখলে মনের ভেতরটা আপনাআপনি পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা রাস্তাঘাট সাফ করতে পারিনি, তাই মনের মধ্যেও রয়ে গেছে মারাত্মক ময়লা।
চতুর্দিকে ইতিহাসের লেকচার। তবে উঠতি ছেলেমেয়েদের আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে ব্যবসায় প্রশাসনের (বিবিএ/এমবিএ) লেকচার শোনায়। যে বিষয়ে পেট ভরে না, সে বিষয়ে মানুষের চিরকাল আগ্রহ কম। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাহিত্য নয়, দর্শন নয়, পদার্থবিজ্ঞান নয়, বেশি ভিড় ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে। পাস দিচ্ছে অজস্র, চাকরি পাচ্ছে অল্প। ফলে শতকরা ৮০ ভাগের জীবনে আসে হতাশা।
হতাশাগ্রস্ত মানুষ একসময় যেকোনো উগ্র পথে নামতে পারে। ধর্মীয় উগ্র পথে নামতে পারে তলোয়ার নিয়ে, মাওবাদী চরমপথে
দীক্ষা নিতে পারে চায়নিজ রাইফেল বা পিস্তল কোমরে গুঁজে। তলোয়ার হোক, চায়নিজ রাইফেল হোক বা পিস্তল হোক, সাধারণ
মানুষ তার সবগুলোই ডরায়। বিশেষ করে আধুনিককালে আত্মঘাতী হামলা ঘটানোর আনন্দ যারা একবার পেয়েছে, তাদের কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাবারও সাধ্য নেই পাকড়াও করে। পাকিস্তানে গিয়ে দেখে আসুন। ভারত থেকে মাওবাদীদের বীরত্বের খবর প্রায়ই আসে।
নানা রকম হতাশার মধ্যেও বহুদিন পর আমেরিকার নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অ্যানগাস ডেটনের এক মন্তব্যে বড়ই আনন্দ পেয়েছি। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক গত সপ্তাহে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর বিজনেস ইকোনমিকসের এক সম্মেলনে বলেছেন, আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশই বসবাসের জন্য ভালো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈষম্য কমলেও আমেরিকায় তা বাড়ছে। আমেরিকায় বসবাস করার চেয়ে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে বাস করা ভালো। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে ৩০ লাখ মানুষ। বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা, চিকিৎসাসেবা ও শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ। দরিদ্রদের সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি থাকলেও খুব কম মানুষই এ সুযোগ নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের গড় আয়ু বাংলাদেশের মানুষের বড় আয়ুর অনেক নিচে।’ [বাংলাদেশ প্রতিদিন]
খুবই খুশির কথা। পরিকল্পিতভাবে হোক বা নির্বুদ্ধিতাবশত হোক, শিক্ষাক্ষেত্রে বিপর্যয় না ঘটালে, সত্য প্রকাশে বাধা ও জ্ঞানচর্চার দরজা বন্ধ করে না দিলে, আমরা আমেরিকার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভালো করতাম। ভারতীয় উপমহাদেশে একটি মহত্তম সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল সত্যানুসন্ধান ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। তখনো রাজরাজড়া ছিলেন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ছিল, রক্তারক্তি ছিল, সামন্তপ্রভুদের রাজনীতিও ছিল, একই সঙ্গে ছিল জ্ঞানচর্চার অনুকূল পরিবেশ। নষ্ট রাজনীতির নোংরা মাখিয়ে শাসকশ্রেণি জনগণকে পর্যন্ত কর্মদাক্ত করে দেয়নি।
আজ উঁচু উঁচু দালান উঠছে, কিন্তু যা মানবিক তার সবকিছু ভেঙে পড়ছে। জাতির ঐতিহ্যগত যা কিছু ভালো ছিল, তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। পশ্চিমা কবির ভাষায়, ‘থিংকস ফল অ্যাপার্ট, সেন্টার ক্যান নট হোল্ড’। ব্যক্তিতে– ব্যক্তিতে সম্পর্ক চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ভেঙে পড়ছে। সম্পর্ক থাকছে না বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের। জীবন ও মানবিক মূল্যবোধের চেয়ে দলীয় রাজনীতি বড় হয়ে উঠেছে। আজ কোনো পরিবারে কারও পরিচয় আওয়ামী লীগ বা বিএনপি হিসেবে। মানুষ হিসেবে নয়, রক্তসম্পর্কের চেয়ে দলীয় সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও সম্প্রীতি ছাড়া জাতীয় জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে না।
মানুষ নিয়ে রাষ্ট্রের কারবার। পশু-পক্ষী ও গাছগাছালি নিয়ে নয়। মানুষ জটিল প্রাণী। তার সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে চলা সহজ নয়। ভালোত্বের সঙ্গে অশুভ শক্তি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। উচ্চতর আদর্শ স্থাপন করে অশুভ প্রবৃত্তিকে দমন করার ব্যবস্থা না করে অধিপতিশ্রেণি বা রাষ্ট্র তা আরও চাড়িয়ে দিচ্ছে। তার পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হবে। মনে রাখা দরকার, অতি উঁচু দালান বানানোর চেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে উঁচু আদর্শ স্থাপন হাজার গুণ বেশি মূল্যবান।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷