গাইবান্ধার সাঁওতালি গ্রামে চলছে কান্না আর হাহাকার। নিজ দেশের পুলিশ ও প্রশাসনের তাণ্ডবে তারা স্তম্ভিত, দিশেহারা। কমপক্ষে তিনজন সাঁওতাল কৃষক নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আরও একজন সাঁওতাল নারী মারা গেছেন। তাঁর নাম জানা যায়নি। শ্যামল হেমব্রমের লাশ কয়েক দিন ধরে দিনাজপুর মেডিকেলের মর্গে পড়ে ছিল। সন্ত্রাসী ও পুলিশের মিলিত অত্যাচার ও গ্রেপ্তারের ভয়ে তাঁর স্বজনদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঘটনার বিভীষিকায় সাঁওতালেরা স্তব্ধ হয়ে গেছেন। গ্রামে আগুন লাগানোর ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। ঘটনাস্থলে আগে থেকেই পুলিশ মোতায়েন ছিল। তারপরও পুলিশ বলেছে, কে বা কারা আগুন দিয়েছে, তারা জানে না। হামলায় তিন সাঁওতাল নিহত হয়েছেন, তাঁদের শরীরে গুলির দাগ, আহত ব্যক্তিদের শরীরে বিঁধে আছে গুলি। গুলির হিসাব নেওয়া হোক। চরন সরেন ও বিমল কিস্কু হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। বৃদ্ধা মুংলি সরেন বুলেটবিদ্ধ হয়ে বাড়িতেই আছেন। দ্বিজেন টুডু চোখে বুলেটবিদ্ধ হয়ে এখন ঢাকার চক্ষু হাসপাতালে আছেন। তাঁকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে আর রশি দিয়ে বেঁধে হাসপাতালের বেডের সঙ্গে আটকে রেখেছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর একজন সাঁওতাল কৃষক এই নিষ্ঠুর নগরে এভাবে পড়ে আছেন। বাগদা ফার্মের পাশের মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের সাঁওতালদের বাড়িতে প্রকাশ্যে লুটপাট চালানো হয়েছে। ভয়ে ও আতঙ্কে গ্রামের মানুষ বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় ক্যাথলিক গির্জাঘরের সামনে। সাঁওতাল তরুণেরা বলেছেন, তাঁরা তো একাত্তর দেখেননি, এখন দেখছেন সাম্প্রদায়িকতা কত ভয়ংকর, মানুষ কত বর্বর হতে পারে।
এখানে সংক্ষেপে বলা দরকার যে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি মহিমাগঞ্জ সুগার মিলের জন্য অধিগ্রহণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। এলাকাটি সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম নামে পরিচিত। অধিগ্রহণের ফলে ১৫টি আদিবাসী গ্রাম ও ৫টি বাঙালি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চুক্তিতে লেখা ছিল, অধিগ্রহণকৃত জমিতে আখ চাষ করা হবে। আখ চাষ না হলে এসব জমি আগের মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এটি ছিল লিখিত চুক্তি। অধিগ্রহণের পর বেশ কিছু জমিতে আখের চাষ হয় এবং আখ দিয়ে চিনি উৎপাদন করা হয়। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে ৩১ মার্চ ২০০৪ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরে নানা সময়ে কখনো চালু হয়, আবার বন্ধ হয়। এভাবেই চলতে থাকে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নিয়ম লঙ্ঘন করে অধিগ্রহণকৃত জমি বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। অধিগ্রহণের চুক্তি লঙ্ঘন করে আখ চাষের জন্য বরাদ্দকৃত জমিতে ধান, গম, সরষে, আলু, তামাক ও ভুট্টা চাষ শুরু হয়। সেখানকার আদিবাসী ও বাঙালি জনগণ বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করে। জনগণের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকা সরেজমিনে তদন্ত করেন। তদন্তে তিনি জমিতে ধান, তামাক ও মিষ্টি কুমড়ার আবাদ দেখতে পান। চুক্তি অনুযায়ী এসব জমি আদিবাসী-বাঙালিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সংগ্রামের সময় এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো। মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি করছে, একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এই ঘটনার বিচার করা হোক।
প্রথম আলোর ১০ নভেম্বরের প্রতিবেদন অনুসারে মাদারপুর গ্রামের সাঁওতাল নারী ছানি বাস্কে বলেছেন, ‘আমাদের ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শাড়ি, কাপড়, পাঁচটি ছাগল, ২০টি মুরগি, ছয়টি হাঁস ও চাল-ডাল পুড়ে গেছে। আমাদের এখন খাবার নেই। সকালে লবণ-চা খেয়েছি। চার বছরের মেয়েকে কী খাওয়াব, চিন্তায় আছি।’
বিভীষিকাময় এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বর্ণনা দীর্ঘায়িত করা যায়। তাতেও কি সরকারের চৈতন্য হবে? গরিব সাঁওতাল কৃষকের কান্না আর হাহাকার সরকারের কানে কি পৌঁছাবে? আমি প্রায়ই বলি, এই রাষ্ট্র আমরা চাইনি। আমরা একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম। এখন সব দেখে মাঝেমধে্য মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি আমাদের প্রিয় এই দেশ সংবেদনশীলতা ও অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে? বিশেষ করে, গরিব কৃষক, প্রান্তিক শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জন্য? সংবেদনশীলতা নষ্ট হওয়া তো একধরনের অসুস্থতা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সিধু-কানু সাঁওতালরা তির ছুড়েছিল। এখন তো ঔপনিবেশিক শাসন নেই। তবে কেন আজও সাঁওতালদের তির ছুড়তে হয়? কেন এত অত্যাচার সাঁওতালদের সইতে হয়?
আমার এক সাঁওতাল বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আমরা কি এ দেশে থাকতে পারব? বুদু উঁরাওয়ের মতো চলে যেতে হবে না তো? আমাদের ছেলেমেয়ে কি এ দেশে সম্মান নিয়ে থাকতে পারবে?’
আমি এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ভার সরকারের কাছে ছেড়ে দিলাম। রাষ্ট্রকেই এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। রাষ্ট্র যদি সংবেদনশীলতা হারায় বা অসুস্থ হয়ে যায়, তবে তো সাঁওতালদের তাদের দেবতা সিংবোঙার কাছে, ঈশ্বরের কাছে জবাব খুঁজতে হবে। হায়, তাহলে ঈশ্বরও কি সাঁওতালদের ভুলে গেছে?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।