মরণোত্তর শব্দটি বাংলাদেশে বহুল পরিচিত। আমাদের রাষ্ট্রে পদক-পুরস্কার দুই ভাগে বিভক্ত। কিছু সরকারি, কিছু বেসরকারি। বেসরকারি পদক-পুরস্কার সাধারণত জীবিতদের দেওয়া হয়। সরকারি পদক-পুরস্কার জীবিত ও পরলোকগত উভয় শ্রণিকেও দেওয়া হয়। পরলোকগত ব্যক্তিদের পদক-পুরস্কারের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা থাকে ‘মরণোত্তর’।
বড় ধর্মগুলোতে ভালো কাজের জন্য পরলোকে পুরস্কৃত হওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। মরণোত্তর কথাটা ভালো শোনায় না। সরকারি অনেক কিছুরই নাম বদল করা হয়েছে। মরণোত্তর পুরস্কার কথাটা বদলে ইহলোকোত্তর পুরস্কার বা ইন্তেকালোত্তর ইনাম করা যেতে পারে। শুভ ব্যাপারে মরণ শব্দটি থাকায় পুরস্কারপ্রাপ্তির আনন্দের মধ্যে একটি কালো ছায়া পড়ে। মরণ বড়ই বেদনাদায়ক জিনিস।
মরণোত্তর পুরস্কারের নীতিমালা কী, তা আমাদের জানা নেই। অর্থাৎ, যে বছর পুরস্কার প্রদান করা হলো, তার কমপক্ষে কত বছর আগে ইন্তেকাল করলে একজন পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। পুরস্কার প্রদানের পূর্ববর্তী বছর পরলোকগমন এক কথা আর এক যুগ আগে বা অনির্দিষ্টকাল আগে গত হওয়া অন্য ব্যাপার। যদি সে রকম নীতিমালা না থাকে, তাহলে কোনো সরকার মান্ধাতার আমলের বা মোগল আমলের কোনো কৃতীকেও মরণোত্তর পুরস্কার দিয়ে ভূষিত করলে কেউ প্রশ্ন তুলবে না।
দেশে পালাক্রমে নানা ধরনের সরকার আসে। অতি প্রগতিশীল ও অতি প্রাচীনপন্থী সরকারের আবির্ভাব ঘটা অসম্ভব নয়। কখনো যদি প্রবল প্রগতিশীল সরকার অধিষ্ঠিত হয়, তারা পুরস্কার দেওয়া শুরু করতে পারে ফকির লালন শাহ বা তারও আগে থেকে। সমাজসংস্কারে রামমোহন রায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর, ধর্ম সংস্কারে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন, সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা ওরফে বিদ্যাসাগর, সংগীতে রামপ্রসাদ সেন, কবিতায় ভারতচন্দ্র রায়, প্রবন্ধে অক্ষয় কুমার দত্ত, উপন্যাসে যৌথভাবে প্যারীচাঁদ মিত্র ও মীর মশাররফ হোসেন ইহলোকোত্তর পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য।
ইসলামপন্থী সরকার ক্ষমতায় এলে ধর্ম সংস্কারে হাজি শরীয়তুল্লাহ, রাজনীতিতে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর, সমাজ সংস্কারে মুন্সি মেহেরুল্লাহ, কবিতায় কাজেম আল কোরেশী ওরফে কায়কোবাদ ও সৈয়দ এমদাদ আলী, উপন্যাসে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, রাজনীতিতে নবাব সলিমুল্লাহ ও সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী মরণোত্তর পদক-পুরস্কার পেলে কেউ আপত্তি করবে না। আরও দূরে যদি যেতে চান তাঁরা, তাহলে সৈয়দ আলাওল ও সৈয়দ হামজা থেকে শুরু করতে পারেন। যে দেশে আবদুল হামিদ খান ভাসানী ইন্তেকালোত্তর পদক পেয়েছেন, সেখানে আবুল কাশেম ফজলুল হক ওরফে শেরেবাংলা না পেলে অবিচার করা হবে। ভবিষ্যতে কোনো সরকার যদি মনে করে তাঁর লেখা গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মরণোত্তর একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি, তা খুবই অবহেলা, সুতরাং তাঁকে ভাসানীর মতো পদক-পুরস্কার দেওয়া দরকার। অবশ্য বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সাধারণ কবি কাজী নজরুল ইসলামও একুশে পদক পেয়েছেন।
ইহলোকোত্তর পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু বাস্তব জটিলতা রয়েছে। সব মানুষ উত্তরাধিকারী রেখে জান্নাতবাসী বা স্বর্গবাসী হন না। যিনি পুরস্কৃত হন, তাঁর দুনিয়ায় কোনো উত্তরাধিকারী না-ও থাকতে পারে। অথবা কেউ রেখে যান তাঁর হেরোইন-ইয়াবাসেবী পুত্রধন। যাঁকে পদক প্রদান করা হয়, সেটা তাঁর গলাতেই শোভা পাওয়ার কথা। পদকটা প্রদান করা হলো একজনকে, কিন্তু সেটা পরিয়ে দেওয়া হলো আরেকজনের গলায়। হোক সেই গলা তাঁর স্ত্রী বা স্বামী, পুত্র বা কন্যা বা নাতি-নাতনির। তিনি যদি বিপত্নীক হন এবং তাঁর ভাই-বোন ভাতিজি-ভাগনি কিছুই না থাকে, তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি বা শালা-শালি মেডেল নিতে আসেন তাতে প্রাপকের কী প্রাপ্তি?
ইন্তেকালোত্তর পুরস্কারের আরেকটি জটিলতা হলো, যদি কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় একাধিক বিয়ে করে থাকেন এবং প্রত্যেক স্ত্রীর গর্ভে একাধিক সন্তান রেখে দেহত্যাগ করেন, তখন তাঁদের মধ্যে বিবাদ বেধে যেতে পারে। সে রকম ঘটনা আশি ও নব্বইয়ের দশকে স্বচক্ষে দেখেছি। সব পক্ষের ছেলেমেয়েরাই দাবি করেছেন তাঁরা পদকপ্রাপকের ঔরসজাত সন্তান বা নাতি-নাতনি।
পদকের ব্যাপারে আরেকটি সমস্যা আছে-সেটি খাঁটি সোনা না নকল সোনা। স্বর্ণ আর তামা-পিতল ধাতু হিসেবে দেখতে একই রকম। ইহলোকোত্তর পুরস্কারপ্রাপকদের উত্তরাধিকারীদের কাছে ধাতুটাই মূল্যবান। বিদেশি বন্ধুদের যখন পদক দেওয়া হয় এবং মেডেলের ধাতুর আসলত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন আমি প্রস্তাব করেছিলাম, ভবিষ্যতে পদক বানানোর সময় সেটা খাঁটি সোনা না নকল, তা পরীক্ষার জন্য জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টিমকে যেন আমন্ত্রণ করে আনা হয়।
বাংলাদেশ যেহেতু একটি অত্যন্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এখানে প্রতিটি সরকার যে কাজটি করতে পারে তা হলো, যে বছর যাঁরা পুরস্কার পাচ্ছেন, শুধু তাঁদের নামই নয়, ওই সরকার ক্ষমতায় থাকলে (হতে পারে দুই বা তিন মেয়াদ) আর কারা কারা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবেন, তাঁদের তালিকাও করা। ওয়েটিং লিস্টে থাকলে কামড়াকামড়ি হয় না। যেমন ২০২১ সালে কে পুরস্কৃত হবেন, ২০৩১ সালে বা ২০৪১ সালে কে, তাঁদের নামও বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা।
কাজটি যদি সরকার না-ও করে, বড় দলগুলো আরেকটি কাজ করতে পারে। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যে অগণিত প্রতিশ্রুতি থাকে, তার সঙ্গে হবু পুরস্কৃতদের নামেরও তালিকা রাখতে পারে। তাতে সুবিধা হবে এই যে ওই সময়সীমার মধ্যে যদি কেউ ইহলোক ত্যাগ করেন, তাহলে অবধারিতভাবে তিনি পরবর্তী বছর পুরস্কার পাবেন। তাতে হবু পুরস্কারপ্রাপকেরা মৃত্যুর আগে তাঁদের পুরস্কার গ্রহণের নমিনি ঠিক করে যেতে পারেন। নমিনি করার মতো যদি একাধিক ব্যক্তি থাকেন, তাহলে তিনি তারও সুরাহা করে যেতে পারেন।
অনেক দেশেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীর্তিমান ব্যক্তিদের পদক-পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। পুরস্কৃত করা হয় কৃতী ব্যক্তিকে, তাঁর আত্মাকে নয়।
আমরা সবকিছুকেই খেলো করে ফেলেছি ক্ষুদ্র স্বার্থে। অবশ্য রাষ্ট্র কাউকে সম্মানিত করতে পারে না। কেউ যদি সম্মানিত হন বা স্বীকৃত হন, তা হন মানুষের দ্বারা তাঁর কাজের জন্য। বাঙালি জানে না কীভাবে পছন্দের বা খাতিরের ব্যক্তিটিকে পুরস্কৃত করতে হয়। সে আরও জানে না অপছন্দের বা বিরোধীকে কীভাবে শাস্তি দিতে হয়। পুরস্কৃত করা ও শাস্তি দেওয়ার মধ্যে কোনো সরকারের নীতি, আদর্শ ও চারিত্রেযর প্রকাশ ঘটে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক