আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত নির্বাচনটি সুষ্ঠু হতে হবে, দ্বিতীয়ত তা গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তৃতীয়ত বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। নির্বাচনের যত কাছাকাছি আমরা যাচ্ছি, ওই তিনটি বিষয়ে নানা প্রশ্ন প্রবলভাবে সামনে চলে আসছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের। তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রধান আলোচনা ছিল তারা কী কথা বলছে, কোনো দলের প্রতি তারা পক্ষপাতিত্ব করছে কি না—এই সব।
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী মনোনীত করার পর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করার কাজটি করছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এত দিন বিভিন্ন ধারণার ভিত্তিতে তাদের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এখন তাদের কর্মকাণ্ডকে সুনির্দিষ্টভাবে মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠছে, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারা একই সূচকে দুই দলের ক্ষেত্রে ভিন্ন আচরণ করছেন। এমন অভিযোগ উঠেছে যে, ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে সরকারি দলের অনেক প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হচ্ছে না। অথচ একই অভিযোগে বিরোধী দলের মনোনয়ন–প্রত্যাশীদের ক্ষেত্রে বিপরীত মতামত দেওয়া হচ্ছে। এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার এক বক্তৃতায় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তুচ্ছ কারণে যেন কারও মনোনয়ন বাতিল না হয়। কিন্তু মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর না থাকা, বিএনপির মহাসচিবের স্বাক্ষর দু রকম মনে হওয়ার মতো করণিক বিষয়কে সামনে এনে প্রার্থিতা বাতিল করার মতো ঘটনা ঘটেছে। নিছক ‘মনে হওয়া’কে এভাবে আমলে নিয়ে কোনো প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ওই সব কর্মকর্তারা কতটুকু দক্ষ সে প্রশ্নও সামনে চলে এল। আমাদের মনে রাখতে হবে, অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে একটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। আর তা পূরণে এসব কর্মকর্তারা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্যভাবে কাজ করছেন সে প্রশ্ন অনেকেই তুলবেন।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ও যাচাই–বাছাই করার জন্য আর মাত্র তিনদিন সময় আছে। রির্টানিং কর্মকর্তারা যাই করে থাকুক না কেন, তাদের ভুলের দায় যেন নির্বাচন কমিশন নিজের কাঁধে না নেন। যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে তাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রে ছোটখাটো যেসব ভুল করেছেন, সেগুলোকে আমলে নেওয়া মোটেই উচিত হবে না। সেসব সংশোধন করার সুযোগ দিয়ে সব দলের প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। ঋণখেলাপের ইস্যুতে সরকারি দলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, বিরোধী দলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের আচরণে যাতে কোনো বৈষম্যের অভিযোগ না ওঠে।
একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের মনোভাবের প্রকাশ যাতে প্রশাসনের সবাই বুঝতে পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। তারা কোনো একটি পক্ষের দিকে হেলে পড়ছেন, সে অভিযোগ যাতে না ওঠে। আগামী তিন দিনের মধ্যে তাদের এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে নির্বাচনে সব দলের সব যোগ্য প্রার্থী সমানভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। এটা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য হওয়া নিয়ে যে সংশয়গুলো মানুষের মনে আছে, তা আরও দৃঢ় হবে। খুঁটিনাটি আইনি বিষয় যাতে সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। এই দায়িত্ব পালনের জন্য আগামী তিনটি দিন তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হোসেন জিল্লুর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা