ইসলামে সময়কে কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে
সময় আল্লাহর দান। সময়ের সমষ্টিই জীবন। মানবজীবনে সময়ের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, তাই সময়ের মূল্যায়ন করা অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মহাকালের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়; যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্য ধারণে সহায়তা করে।’ (সুরা আসর, আয়াত: ১-৩)।
সময়ের হিসাবের নিমিত্তে আল্লাহ তাআলা চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেছেন। কোরআনের বর্ণনা, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের মনজিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’ (সুরা: ১০ ইউনুস, আয়াত: ৫)। ‘আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। এবং চন্দ্রের জন্য আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মনজিল; অবশেষে সেটি শুষ্ক বক্র পুরোনো খর্জুর শাখার আকার ধারণ করে।’ (সুরা: ৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ৩৮-৩৯)। ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী-পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস ১২টি।’ (সুরা: ৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬)।
নতুন বছর মানে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়া। আবার জীবনের নির্ধারিত আয়ু থেকে একটি বছর চলে যাওয়াও। অকল্যাণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে কল্যাণের পথে ধাবিত হওয়ার শুভ যাত্রা শুরু করা। তাই নতুন বছর এলে পড়া হয়, ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ওয়াল আবছার, ইয়া মুদাব্বিরাল্লাইলি ওয়ান্নাহার; ইয়া মুহাওয়িলাল হাওলি ওয়াল আহওয়াল, হাওয়িল হালানা ইলা আহ্ছানিল হাল।’ অর্থাৎ ‘হে অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ পরিবর্তনকারী! হে রাত ও দিনের আবর্তনকারী! হে সময় ও অবস্থা বিবর্তনকারী! আমাদের অবস্থা ভালোর দিকে উন্নীত করুন।’ (আন নাহজুল বালাগা)।
অতীতের পাপরাশির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা ও ভবিষ্যতে পাপকাজ না করার অঙ্গীকার করা হোক নতুন বছরের প্রত্যাশা
নতুন মাস দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। নতুন মাসে সময়ের মালিকের কাছে এ আবেদন, ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ইমান, ওয়াছ ছালামাতিয়াল ইসলাম; রব্বি ওয়া রব্বুকাল্লাহ; হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলামসহযোগে আনয়ন করুন; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এ মাস সুপথ ও কল্যাণের।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৪৫১, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৪০০)।
অতীতের পাপরাশির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা ও ভবিষ্যতে পাপকাজ না করার অঙ্গীকার করা হোক নতুন বছরের প্রত্যাশা। কোরআনে আল্লাহর ঘোষণা, ‘আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে সৃষ্টি করিনি।’ (সুরা জারিয়াত: ৫১-৫৬)। এ ঘোষণা মাথায় রেখে আমাদের জীবন পরিচালিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে আনন্দ-উৎসবে আল্লাহর অবাধ্যতা বাঞ্ছনীয় নয়, বরং আল্লাহর আদেশ পালনের মাধ্যমেই মুসলিমের আনন্দ নিহিত। মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজে থাকবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাদের ইমান, আখিরাতের প্রতি অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা।
নববর্ষ হলো সময়ের একটি অংশ থেকে অন্য অংশে পদার্পণ। এটি হলো নিজেকে পরিবর্তন ও উন্নয়নের একটি সুযোগ। এ সময় উচিত জীবনের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া করা, হায়াতের জন্য দোয়া করা। অতীতের গুনাহ ও ভুলের জন্য তওবা–ইস্তিগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনা করা। কারও জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ও সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং ভবিষ্যতে নেক আমলের সংকল্প করা।
ইমাম আবু হানিফা (র.)-এর দাদা তাঁর পিতা ছাবিত (র.)-কে পারস্যের নওরোজের দিনে হজরত আলী (রা.)-এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আলী (রা.)-কে কিছু হাদিয়া পেশ করেছিলেন। হাদিয়াটি ছিল নওরোজ উপলক্ষে। তখন আলী (রা.) বললেন, ‘নওরোজুনা কুল্লা ইয়াওম।’ অর্থাৎ ‘মুমিনের নওরোজ প্রতিদিনই।’ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব-নিকাশ করবে এবং নব উদ্যমে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে। (আখবারু আবি হানিফা র.)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম