বারাক ওবামা ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেই আশা করেছিলেন, তাঁর জয়ের পর বুশ প্রশাসনের ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সরে আসবে। কিন্তু দেখা গেল মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিইয়ে রাখা, মুসলমানদের ওপর অতিমাত্রায় নজরদারি করা এবং তাদের অভিবাসন দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নীতি অনুসরণ করা—এসব নীতি থেকে ওবামা সরে আসেননি। বরং তাঁর সরকারকে ইসলামভীতি ছড়ানোয় বেশি আগ্রহী দেখা গেছে।
ওবামা সরকার ইউএস প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট নবায়ন ও সম্প্রসারণ করেছিল। ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনীর বিমান থেকে ফেলা বোমায় নিহত বেসামরিক নারী ও শিশুদের পর্যন্ত ওবামা ‘শত্রু যোদ্ধা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে ‘কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’ শীর্ষক যে উগ্রপন্থী মোকাবিলা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, সেটি আদতে সাধারণ মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ওপর ‘কোমল নজরদারি’ প্রকল্প ছিল।
ওবামা একটি কুখ্যাত ‘কিল লিস্ট’ বা হত্যার তালিকা বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই তালিকা ধরে মার্কিন বাহিনী বিভিন্ন মুসলিম নেতাকে হত্যা করেছে। সন্ত্রাসী সন্দেহে কোনো মার্কিন নাগরিককে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখার বিধান তিনিই চালু করেন। এসবের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, ওবামা শুধু বুশ জমানার ইসলামভীতির ধারাবাহিকতা ধরেই রাখেননি, তা সুপরিকল্পিতভাবে উসকে দিয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে এখন আবার ভোটারদের সামনে প্রশ্ন উঠেছে ইসলামভীত রিপাবলিকান প্রশাসনকে রুখে দেওয়া জরুরি কি না। কিন্তু তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচনে যদি ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন ও তাঁর রানিং মেট কমলা হ্যারিস জেতেন, তাহলে কি মার্কিন প্রশাসন ইসলামভীতি ছড়ানোর মনোভাব থেকে সরে আসবে?
ইসলামোফোবিয়াকে প্রায়ই ভুলবশত কট্টর মুসলিমবিদ্বেষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কিন্তু ইসলামভীতির অপেক্ষাকৃত ভালো সংজ্ঞা হবে সংগঠিত ও পরিকল্পিত বর্ণবাদ; অর্থাৎ যেটি কিনা কোনো ব্যক্তির আচরণের বিষয় নয়। ঠিক এই কারণে মুসলমানদের হেনস্তা করা বা গণমাধ্যমে তাদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতার মূলে আছে রাষ্ট্রের নীতি ও চর্চা।
আপনি যখন ইসলামভীতিকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন, তখন ওবামা রমজান মাসে ইফতার পার্টির আয়োজন করলেন কি না কিংবা হিলারি ক্লিনটন ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে একজন মুসলমানকে প্রধান বক্তা হওয়ার সুযোগ দিলেন কি না, তাতে কিছু আসবে–যাবে না। জর্জ বুশ আমেরিকানদের তাদের প্রতিবেশী মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে বলেছেন কি না, সেটি কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। আসল কথা হলো আমেরিকান রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি সংশয়হীনভাবে ইসলামোফোবিক। আর আমরা যদি এই সত্য মেনে নিই তাহলে বুঝতে পারব ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যালট অনস্বীকার্যভাবে আমেরিকানদের মধ্যে ইসলামভীতি সম্প্রসারণেরই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমবিরোধী অনুভূতির মানে হলো আমেরিকান যুদ্ধবাজিকে নিঃশর্তভাবে অনুমোদন দেওয়া। এ বিষয়ে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ দিপা কুমার বলেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদের চাকার ঘূর্ণনকে মসৃণ করার জন্যই ইসলামি সন্ত্রাসবাদের ভয় কারখানার পণ্যের মতো উৎপাদন করা হয়।’
এই মুসলিমবিরোধী অনুভূতি কাজে লাগিয়ে নাইন–ইলেভেনের হামলাকে ইরাকে হামলার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করা হয়েছিল। এমনভাবে আমেরিকান রাষ্ট্রযন্ত্র বিষয়টিকে উপস্থাপন করেছিল যেন এই সন্ত্রাসী হামলার জন্য গোটা মুসলিম বিশ্ব দায়ী। ইরাক অভিযানের সঙ্গে নাইন–ইলেভেনকে এমনভাবে মিলিয়ে ফেলা হয়েছিল যে মার্কিন বাহিনী ইরাকে বানানো একটি আটককেন্দ্রের নামকরণ নাইন–ইলেভেন হামলায় নিহত একজন অগ্নিনির্বাপণকর্মীর নামে করেছিল। এমনকি মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে ইরাকি জনগণের ওপর ফেলা একটি বোমার নাম নাইন–ইলেভেন হামলায় নিহত এক ব্যক্তির নামে দিয়েছিল। এমনভাবে রাষ্ট্র নিজেই ইসলামভীতি ছড়িয়েছে যে এক গবেষণায় দেখা গেছে, নাইন–ইলেভেন হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনই কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, সাদ্দাম হোসেনই ওই হামলার জন্য দায়ী।
যাঁরা ভাবছেন বাইডেন ও কমলা ক্ষমতায় এলে ইসলামোফোবিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সরে আসবে, তাঁরা জেনে দুঃখ পাবেন, এই দুজনই আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী সামরিক সম্প্রসারণের কট্টর সমর্থক। সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি নামের একটি থিংকট্যাংক আছে, যাঁদের প্রধান কাঁচামালই হলো মুসলিমবিরোধী চেতনা, সেই সংস্থার সঙ্গে কমলা হ্যারিসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির বহু মুসলিমবিদ্বেষী নেতা ইতিমধ্যে কমলাকে ‘আপন লোক’ বলে ঘোষণা করেছেন। বাইডেনও ইসলামোফোবিক কট্টর ইসরায়েলি গোষ্ঠীর সমর্থক। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইসলামভীতি শিগগিরই কমার লক্ষণ নেই।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
নাজিয়া কাজী: স্টকহোম ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বর্ণবাদবিষয়ক গবেষক