যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে গত মাসে একটি পিটিশন দাখিল করা হয়েছে, তাতে ইসরায়েল সরকারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের আহ্বান জানানো হয়েছে। পিটিশনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের সব ধরনের বাণিজ্যে, বিশেষ করে অস্ত্র রপ্তানিতে সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করা হোক। ওই পিটিশনে ৩ লাখ ৮৬ হাজার মানুষের স্বাক্ষর থাকায় যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট বিষয়টি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে।
সরকার এই পিটিশনের সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছে। সরকার পরিষ্কারভাবে বলেছে, তারা ইসরায়েলকে একঘরে করা কিংবা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এ ধরনের অবরোধ আরোপ করার যেকোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে থাকবে; কারণ, যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে ইসরায়েলের ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে’। আয়ারল্যান্ডে একটি সংশোধনী প্রস্তাবেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের ইস্যুটি এসেছে এবং সেখানে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের হস্তক্ষেপকে ‘কার্যত দখল’ উল্লেখ করে নিন্দা জানানো হয়েছে। যদিও সেই সংশোধনী প্রস্তাব পাস হয়নি, কিন্তু অবরোধের সেই প্রস্তাব সবার সামনে এসেছে।
একটি দেশ যে যে বিধি ভঙ্গ করলে তার ওপর অবরোধ আরোপ করা ন্যায়সংগত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে সেই বিধিগুলো ভঙ্গ করে আসছে। যে বিধি ভঙ্গ করার কারণে পশ্চিমা দেশগুলো ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে, সেই একই অপরাধ ইসরায়েল করার পরও তার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি। শুধু তা–ই নয়, ইসরায়েলের সঙ্গে এসব দেশ পূর্ণমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এসব দেশের কাছ থেকে ইসরায়েল সর্বাধুনিক অস্ত্রসহায়তা পাচ্ছে
এই পিটিশন ও সংশোধনী প্রস্তাব এমন সময় উত্থাপন করা হলো, যখন ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর অত্যাচার–নির্যাতন অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ ঘটনা হিসেবে গত দুই মাসে ইসরায়েল গাজায় বোমা মেরে অন্তত ২৫৬ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যাদের ৬৬ জনই শিশু।
ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম ফোকাল পয়েন্ট হলো ইসরায়েলের ওপর অবরোধ আরোপের আহ্বানকে জোরদার করা। প্রকৃতপক্ষে, ২০০৫ সালে দেশে দেশে সরকারগুলোকে আন্তর্জাতিক আইন মানার বাধ্যবাধকতার আলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করতে চাপ দেওয়ার জন্য যে জনমত গঠনের আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটির নাম ছিল ‘বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট, স্যাঙ্কশন (বিডিএস) মুভমেন্ট’। এই বিডিএস মুভমেন্টের মূল ভিত্তি ছিল ইসরায়েলের ওপর অবরোধ আরোপের দাবিকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া।
একের পর এক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন চালানোর জন্য ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনসংক্রান্ত ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করা, তাদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করা, তাদের সঙ্গে সামরিক বাণিজ্য সংকুচিত করা, জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মতো আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসরায়েলের সদস্যপদ স্থগিত করা ইত্যাদি এই আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো দেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক অবরোধ আরোপ করবে—এমন বিষয় এক শতাব্দীর বেশি সময় আগে লিগ অব নেশনসে অনুমোদিত হয়েছিল। এক দেশ অন্য দেশের ওপর অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে বা সাধারণ মানুষের ওপর পীড়ন চালালে অন্য দেশগুলো পীড়নকারী দেশের ওপর নানাভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার নজিরও আছে।
যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের অবসানে সে দেশের সরকারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাসহ বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে রাশিয়া হানা দিয়ে সে ভূখণ্ড দখল করার পর মস্কোর ওপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বেশ কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
সমন্বিত সাজা হিসেবেও কোনো কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়ে থাকে। যেমন কিউবায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬২ সালে দেশটির ওপর সব ধরনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এটি কিউবার অর্থনীতিতে বিপর্যয় আনে এবং তার ফলে দেশটির মানুষকে অবর্ণনীয় ক্লেশ ভোগ করে যেতে হচ্ছে। যদিও নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধকে নানাভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে, তারপরও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী শাসকদের নিয়মের মধ্যে আনতে অনেকেই এই পদ্ধতিকে সমর্থন করে থাকেন।
আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী, একটি দেশ যে যে বিধি ভঙ্গ করলে তার ওপর অবরোধ আরোপ করা ন্যায়সংগত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে সেই বিধিগুলো ভঙ্গ করে আসছে। যে বিধি ভঙ্গ করার কারণে পশ্চিমা দেশগুলো ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে, সেই একই অপরাধ ইসরায়েল করার পরও তার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি। শুধু তা–ই নয়, ইসরায়েলের সঙ্গে এসব দেশ পূর্ণমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এসব দেশের কাছ থেকে ইসরায়েল সর্বাধুনিক অস্ত্রসহায়তা পাচ্ছে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ইয়ারা হাবারি প্যালেস্টাইন পলিসি নেটওয়ার্ক আল শাবাকার একজন ফেলো