ইলিশের আসল স্বাদ-গন্ধ হারাতে চাই না!
আজকাল বাড়িতে অতিথি এলে খাবারের পাতে মিঠাপানির মাছ দেওয়াই মুশকিল। প্রশ্ন ওঠে কী মাছ? নদীর না চাষের? অধুনা কই, শিং, মাগুর, পাঙাশ, তেলাপিয়া ইত্যাদি যত্রতত্র ময়লা–পচা, ডোবা পুকুরে চাষ করা হয়। সরপুঁটি, শোল, সিলভার কার্প, রুই, কাতলা, মৃগেল, টেংরা, চিতল এমনকি নদী-বিলের সুস্বাদু পাবদা মাছও এখন পুকুরের বদ্ধ পানিতে চাষ করা হয়। এগুলোর দামও এখন কিছুটা কম। তাই বিশেষ অতিথি এলে তার পাতে দিতে বাধে! মুরগি রান্না হলেও নানা প্রশ্ন শুনতে হয়। দেশি না সোনালি? আমি ব্রয়লার খাই না, ইত্যাদি।
মাছ ও মুরগির ফার্মগুলোতে যে খাবার খেতে দেওয়া হয়, সেগুলো ট্যানারির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হয় বলে সংবাদে প্রচারিত হয়েছে। সেসব পোলট্রি ফিডে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে! কিন্তু বন্ধ হয়নি সেসবের উৎপাদন ও ব্যবহার। আমরা মাছ ও মাংসের মাধ্যমে সেসব বিষ খেয়েই চলেছি হরদম। দেশে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাছ-মাংসের উৎপাদন বাড়ানো হলেও সেগুলো খেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি হচ্ছে কি না, তার কোনো সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ ও নীতিমালা তৈরি হয়েছে বলে জানা যায়নি।
যেমন বিভিন্ন কারণে বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-তুরাগের দূষিত পানিতে বছরের বেশির ভাগ সময় বায়ো-অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি), কার্বন-অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি) সঠিক মাত্রায় থাকে না। তখন ওই পানিতে শৈবাল বা জীবাশ্ম অথবা মাছের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মায় না। ফলে সাধারণ মাছ বেঁচে না থাকলেও কাদার নিচে লুকিয়ে থাকা কিছু প্রজাতি তখনো বেঁচে থাকে। তাই চৈত্র মাসেও বুড়িগঙ্গার মতো বিষাক্ত পানির নদীগুলোর তলদেশ থেকে শিং-মাগুর মাছ শিকার করতে দেখা যায়। সেগুলো বাজারে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। ওসব মাছের দেহে কোনো ক্ষতিকর উপাদান আছে কি না, এ বিষয়ে কোনো গবেষণা রিপোর্ট গণমাধ্যমেও আসে না। পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য দ্বিতীয় শহরের তালিকায় উঠে আসা রাজধানী শহরের মানুষগুলোর এসব বিষয় নিয়ে ভাবার সময় আছে কি?
৯ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার একটি ডোবার নোংরা পানিতে একেকটি ১৭ কেজি ওজনের বিদেশি মাগুর মাছ শিকার করা হয়েছে। পুকুরের মালিক অত বড় ভয়ংকর মাগুর মাছ দেখে শিকারিকে বিনা মূল্যে মাছগুলো দিয়ে দিয়েছেন। কারণ নিজের বা পরিবারের জন্য রাক্ষুসে মাছগুলো রাখতে চাননি!
এবারের কোরবানির ঈদে বাজারের সবচেয়ে বড় ষাঁড়টির ওজন ছিল ৫২ মণ (নাম রাজাবাবু, দাম ১৫ লাখ টাকা)। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত গরুটির ক্রেতা জোটেনি। পরে দাম কমিয়ে সঙ্গে একটি খাসি বোনাস দিয়ে বিক্রি করা হয়েছিল। জানা গেছে, ঈদের বাজারের অনেক হোমরাচোমরা গরু ছিল হাইব্রিড অথবা ক্লোন সঞ্জাত। বিদেশ থেকে আমদানি করা। যার অস্বাভাবিক পরিচর্যা ও দামি খাদ্যাভ্যাস ছিল। তবে মানুষ ছোট জাতের দেশি পশু বেশি আগ্রহ নিয়ে কিনেছে। গরু-খাসি ও মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশেষ সাফল্য লাভ করে চলেছে। আমরা বিশ্বে এ জন্য চতুর্থ স্থান দখল করে ফেলেছি। আশার কথা, সামনে আরও এগিয়ে যাব।
এদিকে লোনাপানির মৎস্য চাষে সাদা সোনা চিংড়িতে সাফল্য ধরা দিলেও রুপালি ইলিশে তেমন সাফল্য এখনো আসেনি। ইলিশ মাছ নদী-সাগর-নদী মিলে দ্বিচারী ভূমিকায় যাযাবর জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত। এরা অমাবস্যা-পূর্ণিমার দিনক্ষণ বুঝে ঝাঁক বেঁধে চলে। হাজার কিমি পাড়ি দিয়ে দক্ষিণের বঙ্গোপসারের ইলিশ বর্ষাকালে উত্তরের তিস্তা-ধরলা নদীর মোহনা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়ে ভারতের শিলিগুড়ির কাছ তোরসা, রত্নাই, মানসা প্রভৃতি ছোট নদীতে গিয়ে শিকারির জালে আটকা পড়তে দেখা যায়। এদের জীবন চলার পথ বড়ই বিচিত্র!
সেই ইলিশের জীবনচক্রের বৈজ্ঞানিক রহস্য সম্প্রতি উদ্ঘাটিত হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একটি গবেষক দল ইলিশের জীবন চক্রের (জেনেটিক কোড) উদ্ঘাটনের ঘোষণা দেওয়ার দুই দিনের মাথায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এক সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন যে তাঁরা ইতিমধ্যে ইলিশের জেনেটিক কোড উদ্ঘাটনের পাশাপাশি তার পেটেন্ট পাওয়ার জন্য আবেদন করে ফেলেছেন! বিষয়গুলো যেভাবেই আসুক না কেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি ইতিবাচক প্রতিযোগিতা ও খুশির বার্তা বহন করে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলে যে অনেক ভালো ফল হতে পারে, তার প্রমাণ ইলিশের জেনেটিক কোড উদ্ঘাটন। পাশাপাশি প্রকল্পের অর্থে পরিচালিত গবেষণায় সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজে ক্যানসার নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কারের ঘোষণার বিষয়টি বেশ আশাজাগানিয়া ব্যাপার।
মানুষের আর্থ-মনোসামাজিক নানা জটিল সমস্যা নিরসনে ও আকাশছোঁয়া চাহিদা পরিপূরণে বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ফলাফল বহু যুগ ধরে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে—তাতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়। পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রায় নানা প্রতিহিংসা ও অনৈতিক চর্চার ফলে মানুষের তথা গোটা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেগুলোও উপেক্ষা করার মতো কোনো অবকাশ কারও নেই।
উন্নত দেশগুলোর সিংহভাগ এখন শূন্য জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি সমস্যায় ভুগে রোবটনির্ভর হয়ে পড়েছে। সেখানে দিনমজুর-শ্রমিকদের মজুরি বাঁচানের জন্য বা বোনাস দেওয়ার ভয়ে রোবট আবিষ্কার করার চিন্তা নেওয়া হলেও বিদ্যুৎ খরচ ও রোবট রক্ষণাবেক্ষণের ভারে পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। এ ছাড়া প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয় তো আছেই। কারণ রোবট তো আর নতুন করতে পারবে না, গবেষণা করবে নতুন আত্মপ্রত্যয়ে প্রতিশ্রুত মানুষ! বাংলাদেশের রয়েছে অনেক প্রতিভাবান মানুষ। তবে এই প্রতিভাবান মানুষগুলো যেন প্রকৃতি ধ্বংসমূলক গবেষণা না করে জীববৈচিত্র্যে সংরক্ষণমূলক গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন, এটাই আমাদের কামনা হওয়া উচিত।
ইলিশের জেনেটিক কোড উদ্ঘাটনের ঘোষণা মনে খুশি আনে। আবার ভয় হয় যদি রাক্ষুসে মাগুর, পাঙাশ বা কোরবানির ষাঁড় রাজাবাবুর মতো বিড়ম্বনা ঘটে! ইরি ধানে চাল মেশিনে বহুবার ছেঁটে মিহি-চিকন করে আতরের গন্ধ লাগিয়ে পোলাওর চাল বলে বাজারে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। সে চালে কি কেউ পোলাও রেধে তৃপ্তি করে খেতে পেরেছেন? একেকটি ইলিশ যদি ডোবার মাগুরের মতো ১৭ কেজি ওজনের হয় ও চাষের পাঙাশের মতো ফ্যাসফ্যাসে স্বাদবিহীন হয়ে যায়, তাহলে সেই ইলিশ আর কৃত্রিম সুগন্ধিমাখা চাল দিয়ে পোলাও রেঁধে আর জামাই-আদর করা ভোজনের আয়োজন সম্ভব হবে না। পুকুরে ইলিশ আবাদের চিন্তা কি আমাদের সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে না?
বাজারে ইলিশের নামে ওমানের স্যাডরিন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের চন্দনা ইত্যাদি বিক্রি করা হয়। ইলিশপাগল মানুষ একদিন ইলিশসদৃশ সেসব মাছ কিনে বাড়িতে নিয়ে এলেও একবার পাতে তোলার তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভের পর আর কোনো দিন সেটা কিনতে আগ্রহী হয় না। আসলে ইলিশের বিকল্প শুধু ইলিশ! ইলিশের তুলনাও সেই ইলিশ—যেটা প্রাকৃতিকভাবে নদী–সমুদ্রে যেটা পাওয়া যায়, সেই স্বাদসমৃদ্ধ রসনা তৃপ্তির ইলিশ। এটার ব্যত্যয় ঘটলে ইউনেসকো কর্তৃক ঘোষিত (জামদানি ও ইলিশের জন্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ খেতাব) আমাদের বিশ্ব ঐতিহ্যের একক স্বীকৃতির গৌরব ম্লান হয়ে যাবে!
আমরা চঞ্চল রুপালি ইলিশকে খাঁচায় বন্দী ঝিমুনিধরা সাদা ব্রয়লার মুরগির মতো দেখতে চাই না। আমরা কেউই ইলিশের আসল স্বাদ-গন্ধ হারাতে চাই না। তাই আসুন, ইলিশের জেনেটিক কোড দিয়ে নতুন গবেষণায় হাত দিই। যে গবেষণা নদী-সমুদ্রে ইলিশের ডিম-পোনা, বংশ রক্ষা করে উৎপাদন বাড়াবে, ইলিশের রোগনির্ণয়, প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি করবে। এ ছাড়া ইলিশের চলাচল, অভয়াশ্রম ও অবস্থান চিহ্নিত করবে, আহরণ, সংরক্ষণ ও সারা বছর বাজারে ইলিশ সরবরাহ নিশ্চিত করার নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা করবে। তবেই ইলিশের জন্য প্রাপ্ত আমাদের বিশ্ব ঐতিহ্যের একক স্বীকৃতির গৌরবগাথা অম্লান থাকবে বলে আশা করা যায়।
* ফখরুল ইসলাম: লেখক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]