সাম্প্রতিক নির্বাচনে ইরাকে ক্ষমতার ভারসাম্যে যে বদল এসেছে, তাতে কুর্দিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে। ইরাক সীমান্তে কুর্দিস্তানকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান ও তুরস্ক বহু বছর ধরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আগ্রাসন শুরু করার পর স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নামে দেশ দুটি। কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (কেডিপি) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে তুরস্ক। অন্যদিকে প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তানের (পিইউকে) সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে ইরান। অতিসম্প্রতি, ইরান–সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী ইরাকের উত্তরাঞ্চলে শক্তি বাড়িয়েছে। তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট অবস্থানে হামলা করছে।
ইরান–সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনৈতিক দল গত মাসের নির্বাচনে খারাপ ফল করেছে। অন্যদিকে আঙ্কারার অনুগ্রহপ্রার্থী সুন্নি ও তুর্কমেন দলগুলো নির্বাচনে ভালো ফল করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনের এই ফলাফল কুর্দিস্তানে প্রভাব বিস্তারের সংঘাত বাড়াবে। তুরস্ক মনে করে ওই অঞ্চলে আঙ্কারার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব খর্ব করছে ইরান। আবার তেহরান অঞ্চলটিকে নিজেদের প্রভাবাধীন এলাকা বলে মনে করে। বাকি ইরাকের ওপর নিজেদের প্রভাব বাড়াতে কুর্দিস্তানকে ব্যবহার করতে চায় তারা।
মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক দুই শক্তির এই দ্বন্দ্ব কুর্দিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। ২০০৩ সালের পর ইরাকে যে ভয়াবহ রক্তাক্ত সংঘাত শুরু হয়েছিল, তা থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়েছিল কুর্দিস্তান। আঙ্কারা ও তেহরান দুই দেশই ঐতিহাসিকভাবে কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। ৯০ দশকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে (পিকেকে) সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তুরস্কও ইরানকে দোষারোপ করেছে। তুরস্কের হাককারি প্রদেশের কাছে ইরাক–সীমানায় পিকেকের ঘাঁটি স্থাপনে সহযোগিতা করেছিল ইরান।
১৯৮৩ সালে কেডিপির সঙ্গে চুক্তি করার পর পিকেকে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী দুর্গ গড়ে তোলে। অন্যদিকে ১৯৮৪ সালের পর থেকে পিইউকে ইরানকে পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। ইরাক-ইরান সীমান্তে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীটি তেহরানের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে ওঠে। ইরানের কুর্দি বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার কাজেও তাদের ব্যবহার করা হয়। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর, কুর্দি দলগুলোকে ব্যবহার করে ইরান ও তুরস্কের উদ্দেশ্যসিদ্ধির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোকে ইরানের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী নতুন করে কুর্দিস্তানে প্রতিযোগিতায় যুক্ত হয়েছে, যা ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। সশস্ত্র ওই গোষ্ঠী ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল।
কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের সহায়তায় পিকেকের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো তুরস্ক উচ্ছেদ করছে। এ বিষয়টা শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ইরান এখন গত অক্টোবরে কুর্দিস্তান সরকার ও বাগদাদের মধ্যে যে চুক্তি সই হয়েছিল, সেটি ভন্ডুল করার পথ খুঁজছে। ওই চুক্তিতে উত্তর-পশ্চিম ইরাকের সিনজার থেকে পিকেকে এবং ইরানের সঙ্গে সম্পর্কিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে বিতাড়নের কথা বলা হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইরবিল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ঘাঁটিতে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়। ওই হামলায় একজন ঠিকাদার নিহত হন, বেশ কয়েকজন আমেরিকান আহত হন। এ হামলার জন্য দায় স্বীকার করে স্বল্প পরিচিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। এই গ্রুপটি ইরানের পক্ষে ছায়াযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। ইরবিলের ওই হামলায় এটাই প্রমাণ করে যে ইরাকের উত্তর অঞ্চলে শিয়া সশস্ত্র যোদ্ধাদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। কুর্দিশাসিত এলাকা থেকে তারা ইরানের তৈরি রকেট হামলা চালায়। সম্ভবত ওই হামলার উদ্দেশ হচ্ছে, ইরাকে অবস্থানরত অবশিষ্ট ২ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনাকে তাড়ানো।
কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের সহায়তায় পিকেকের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো তুরস্ক উচ্ছেদ করছে। এ বিষয়টা শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ইরান এখন গত অক্টোবরে কুর্দিস্তান সরকার ও বাগদাদের মধ্যে যে চুক্তি সই হয়েছিল, সেটি ভন্ডুল করার পথ খুঁজছে। ওই চুক্তিতে উত্তর-পশ্চিম ইরাকের সিনজার থেকে পিকেকে এবং ইরানের সঙ্গে সম্পর্কিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে বিতাড়নের কথা বলা হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে পিকেকের হাতে আটক ১৩ জনকে মুক্ত করার অভিযান শুরু করে তুরস্ক। এর প্রতিক্রিয়ায় একটি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছিল। ইরাকে তুরস্ক ও ইরানের মধ্যকার প্রতিযোগিতা কয়েকটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, শিয়া সশস্ত্র যোদ্ধারা যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের লক্ষ্যবস্তুতে যে হামলা চালাচ্ছে, সেটা ভবিষ্যতে বিক্ষিপ্তভাবে চলতেই থাকবে। তবে এর মাত্রা ইরানের অর্থায়ন ও সমর্থনের ওপর নির্ভর করবে।
দ্বিতীয়ত, তুরস্ক-ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা ইরাকের জাতীয় রাজনীতির ওপর নির্ভর করবে। গত ১০ অক্টোবরের নির্বাচনে ফাতাহ জোট ভালো করেছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত পাঁচমিশালী দলের জোট এটি। তাদের এই উত্থানে তুরস্ক উল্লেখযোগ্য সুবিধা পাবে। তবে, ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তুরস্ক প্রশ্নহীনভাবে প্রভাবিত করতে পারবে না।
তৃতীয়ত, কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকার তুরস্কের গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীকে ইরাকের উত্তরাঞ্চল থেকে পিকেকের ঘাঁটি উচ্ছেদ করতে কতটা সহযোগিতা করছে, তার ওপর ওই অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ অনেকাংশে নির্ভর করবে। সেখানকার রাজনৈতিক অভিজাত অনেকে পিকেকেসহ অন্যান্য গোষ্ঠীকে উচ্ছেদের পক্ষে।
বাকি ইরাকের তুলনায় কুর্দিস্তানে গত কয়েক বছরে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। একটি স্বায়ত্তশাসিত আইনসভার মাধ্যমে পরিচালিত সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা বাকি ইরাকের চেয়ে ভালো। কিন্তু সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে উচ্ছেদের ক্ষেত্রে তারা যদি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, তাহলে কুর্দিস্তানের গণতন্ত্র ও স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়বে। ছায়াযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হবে কুর্দিস্তান।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
বুরকো ওজচেলিক কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির রিসার্চ ফেলো