প্রতিটি শহরেই কিছু কিছু স্থাপনা, ভাস্কর্য, স্থান পাওয়া যাবে, যা দিয়ে ওই শহরকে চেনা যায় অথবা সেই শহরকে বোঝাতে ওই স্থাপনা বা স্থানকে ব্যবহার করা হয়। যেমন সিডনির জন্য সিডনি অপেরা, প্যারিসের জন্য আইফেল টাওয়ার, নিউইয়র্কের জন্য স্ট্যাচু অব লিবার্টি, ঢাকার জন্য আমাদের সংসদ ভবন। কোনো কোনো শহরে কোনো একটি আইকনিক বিল্ডিংও শহরের প্রতীক হয়ে ওঠে। যেমন কুয়ালালামপুরের প্যাট্রোনাস টাওয়ার। আমেরিকান নগর–পরিকল্পনাবিদ কেভিন লিঞ্চ তাঁর বিখ্যাত বই দ্য ইমেজ অব দ্য সিটি বইয়ে এই সব স্থাপনাকে বলেছেন ল্যান্ডমার্ক। এই সব স্থাপনা ধীরে ধীরে শহরের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। সময়ের পরিক্রমায় এই সব স্থাপনা কালজয়ী হয়, ইতিহাসকে নিয়ে যায় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে।
একইভাবে পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এমন অনেক স্থাপনা থাকে, যা ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কার্জন হল, অপরাজেয় বাংলা, শহীদ মিনার, ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসি, রাজু ভাস্কর্য, চারুকলা, দোয়েল চত্বর—এ রকম অনেক স্থাপনা আছে, গণপরিসর আছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। এদের কোনোটিকে ভেঙে ফেললে অথবা এদের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন করলে বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য হারাবে।
২.
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা জায়গায় মানসম্পন্ন গণপরিসরের ব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা, চাহিদা ও ব্যবহারের বিভিন্নতা অনুসারে খেলার মাঠ, সুবিস্তৃত সবুজ লন, নানা প্রকার গাছপালা, বাগান, মিলনায়তন, প্রদর্শনের স্থান, লাইব্রেরি ইত্যাদি থাকে। পড়াশোনা, খেলাধুলা, আড্ডা দেওয়া, বিজ্ঞানচর্চা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সামাল দিতে গিয়ে বিকল্প স্থান নির্বাচন না করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসিকে ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্থান তার সৌন্দর্য ও আবেদন হারাবে।
৩.
বিখ্যাত বসতিবিজ্ঞানের জনক বলে পরিচিত গ্রিক স্থপতি কনস্ট্যান্টিনোস ডক্সিয়াডিস ষাটের দশকের শুরুতে টিএসসির নকশা প্রণয়ন করেন এবং সেই দশকেই স্থাপনাটি তৈরি হয়। পরিকল্পনা, নান্দনিক ও ব্যবহারিক দিক বিচারে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান গণপরিসর। টিএসসির চত্বরে সুপরিসর সবুজ মাঠ, খোলা জায়গা ও হিউম্যান স্কেলের ভবনের উচ্চতা এই গণপরিসরটিকে সবার কাছে আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করেছে। সেই স্থানে টিএসসি ভেঙে বহুতল ভবন করার সিদ্ধান্ত পরিকল্পনার দিক থেকে ভুল সিদ্ধান্ত। আধুনিকায়নের চাপে এলাকাটি তার প্রাণের স্পন্দন হারাবে, একই সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে টিএসসির সঙ্গে জড়িত ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী বহু গুণ বেড়েছে, স্বাভাবিকভাবে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডও বেড়েছে। সময়ের প্রয়োজনে অতিরিক্ত চাহিদার বিপরীতে ভবন নির্মাণের জন্য উপযুক্ত আলাদা স্থান নির্বাচন করা যেতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা যেতে পারে। তা ছাড়া টিএসসির যেসব অংশ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়েছে, তার আধুনিকায়নও প্রয়োজন হতে পারে। দেশে প্রতিষ্ঠিত অনেক পেশাজীবী আছেন, যঁারা এই ধরনের স্থাপনা সংরক্ষণের মাধ্যমে আধুনিকায়নের কাজ করে থাকেন।
৪.
আমি জেনেছি, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ চলছে। সেই মাস্টারপ্ল্যানে টিএসসি এলাকাতে কী ধরনের প্রস্তাব আছে, সেটি যাচাই করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজন ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা হয়েছিল কি না, তঁাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল কি না, এই বিষয়গুলো দেখার দরকার আছে।
৫.
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে স্থাপনা, ভাস্কর্য, নিদর্শন সংরক্ষণের সংস্কৃতি বহু পুরোনো। নগর কর্তৃপক্ষের বাজেটের একটা বিশেষ অংশ বরাদ্দ থাকে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে। আমি বহুদিন আগে সুইডেনে একটা বয়স্ক গাছকেও সংরক্ষণ করতে দেখেছি। স্টকহোম শহরের ডিওরগার্ডেন নামে একটা ছোট্ট আইল্যান্ডে দেখলাম, একটা মৃতপ্রায় বয়োবৃদ্ধ গাছকে নানা প্রচেষ্টায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। ওই আইল্যান্ডের মানুষের বসতির ইতিহাস তুলে ধরতে এই গাছটাকে দেখানো হয়। কারণ, গাছটি সেই দ্বীপের রাজার হাতে লাগানো।
৬.
সন্দেহ নেই সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতা বেড়েছে এবং দেশে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই সুযোগে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন নানা যৌক্তিকতা দেখিয়ে বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের একটা হিড়িক পড়েছে। নতুন চাহিদার বিপরীতে টেকসইভাবে স্থাপনা তৈরি করা যেতেই পারে। কিন্তু সেটা একটা প্রতিষ্ঠিত গণপরিসরকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। আমাদের শহরে খুব বেশি স্মৃতিতাড়িত গণপরিসর নেই। যা আছে সেগুলোকে কীভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, সেই চেষ্টা থাকা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের বিষয় নয়। সারা দেশের জন্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সম্পদ; আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অসংখ্য ইতিহাস ছড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ও প্রাঙ্গণে। এই ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমূহ সংরক্ষণের দাবি তাই দেশের নাগরিকদেরও প্রাণের দাবি।
আকতার মাহমুদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি