স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক রাজনৈতিক হামলা ২১ আগস্ট মামলার রায় নিয়ে যে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে, শিগগির তার অবসান হবে কি না বলা মুশকিল। মামলার উভয় পক্ষই উচ্চ আদালতে আপিল করার ইঙ্গিত দিয়েছে। আর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মৃত্যুদণ্ডের আদেশগুলোর আইনমাফিক পর্যালোচনা বা ডেথ রেফারেন্সেরও শুনানি হবে। সুতরাং মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনো কিছুটা সময়ের ব্যাপার। এ মামলার রায়ের পর অনেকেই বলেছেন, এ বিচারের মাধ্যমে ইতিহাসের দায় পূরণ হয়েছে। তাঁদের কথাটা আংশিক ঠিক, কেননা বিচারহীনতার সংস্কৃতি যখন আমাদের পেয়ে বসেছে, তখন এ ধরনের রাজনৈতিক স্পর্শকাতর মামলার বিচারকাজ শেষ হওয়াটাই একটা বড় ঘটনা। ভুক্তভোগীরা যদি সবাই ন্যায়বিচার পেয়ে থাকেন এবং এ ধরনের নৃশংস ও ঘৃণ্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে যদি এই বিচারটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়, তাহলেই বলা যাবে যে ইতিহাসের দায় মেটানো গেছে।
রায়ের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপিকে নিষিদ্ধ করা উচিত। হামলার ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও হামলাকারীদের সহায়তার অভিযোগে এ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলের নেতৃত্ব থেকে অপসারণের দাবিও উঠেছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে তাঁকে যখন দলটি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছে, তখনই তিনি দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং আইনের চোখে পলাতক। সুতরাং আরেকটি দণ্ডাদেশের কারণে যে তিনি দলের নেতৃত্ব হারাবেন বা স্বেচ্ছায় তা ছেড়ে দেবেন—এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন।
আওয়ামী লীগের এসব বক্তব্যের জবাবে বিএনপির দাবি—বিচার হয়েছে সরকারের ফরমায়েশ অনুযায়ী। মির্জা ফখরুলের দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও বিএনপিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে এ রায় দেওয়া হয়েছে। রায়ের আগে মামলায় যুক্তিতর্কের সময় এবং রায়ের পরও বিএনপির তরফে যে বিষয়টিকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, তা হলো সম্পূরক চার্জশিটে তারেক রহমানকে আসামি করা। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী মুফতি হান্নানের আগের একাধিক স্বীকারোক্তি নাকচ করে বর্তমান সরকারের আমলের পরিচালিত তদন্তের সময়ে নতুন করে নেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তারেক রহমানকে আসামি করায় বিএনপি এ অভিযোগ তুলেছে। সাক্ষ্য–প্রমাণের আইনগত ভিত্তি এবং যথার্থতার প্রশ্ন উচ্চ আদালতের বিচার্য বিষয়। সুতরাং সেই বিতর্কে নজর না দিয়ে আমাদের বরং উচিত হবে এ মামলার অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত, কিন্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছু বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যে দলই থাকবে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেও গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় প্রকাশ্য দিবালোকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলা ছিল বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার অপচেষ্টা।
রায়ে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য উগ্রপন্থী ইসলামি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বা হুজির ষড়যন্ত্রের কথা আছে। তার সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তার কথা আছে। হামলার পরিকল্পনা এবং তা কার্যকর করার অপরাধের মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ হচ্ছে, ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া বা তার যথাযথ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। ঘটনার সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বিএনপি। সুতরাং রাষ্ট্রযন্ত্রের দৃশ্যমান ব্যর্থতার দায় তারা এড়াতে পারে না। বিশেষ করে, মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত করা কিংবা তাকে ভুল পথে পরিচালিত করার দায় স্পষ্টতই তখনকার রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের।
কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অদৃশ্য কর্মকাণ্ডগুলোর বিষয়টি কি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে? জঙ্গিগোষ্ঠী হুজির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর যে বোঝাপড়া হয়েছিল, সেটা কীভাবে সম্ভব হলো? এসব সংস্থা কীভাবে সরকারের বাইরে ক্ষমতার বিকল্প ভরকেন্দ্র হিসেবে বহুল নিন্দিত হাওয়া ভবনের ক্ষমতায়ন করেছে? রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যাদের, সে রকম একাধিক সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিলেমিশে যে রাজনৈতিক অপরাধে যুক্ত হলো, সেই ঘটনার কি উপযুক্ত পরিসমাপ্তি ঘটেছে?
২১ আগস্টের হামলার ঘটনাই বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলের সমাবেশে প্রাণঘাতী হামলার একমাত্র ঘটনা নয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এই হামলার বিচার হয়েছে ১৪ বছর পর। কিন্তু ২০০৪–এর ২৪ বছর আগে ১৯৮০ সালের ২৩ মে খোন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক সমাবেশেও প্রাণঘাতী বোমা হামলা হয়েছে, যাতে একজন সাংবাদিকসহ ১৬ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। সেই হামলায় আহত ব্যক্তিদের অনেকেই দেহে ডজন ডজন স্প্লিন্টার নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের রিপোর্ট যেমন আলোর মুখ দেখেনি, তেমনই তার কোনো বিচার হয়নি।
২১ আগস্টের ঘটনায় যে জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ জড়িত, সেই গোষ্ঠীর তৎপরতা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছে অজানা ছিল—বিষয়টি এমন নয়। ২০০১ সালে পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির জনসভায় হামলার জন্যও দায়ী এই গোষ্ঠী। সেই হামলায় অন্তত পাঁচজন কর্মী নিহতএবং আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এর আগে রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে হামলা, যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা পেতে রাখার ঘটনার মতো অনেকগুলো বড় এবং ভয়ংকর হামলার পরিকল্পনাকারী যে মুফতি হান্নান, তাঁর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার যোগসাজশ, যৌথ ষড়যন্ত্র আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো ও সরকারব্যবস্থার ভয়াবহ দুর্বলতার সাক্ষ্য বহন করে। সেই দুর্বলতা দূর হবে কীভাবে? প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিমের মৃত্যুদণ্ডই কি শেষ কথা? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অভিযোগপত্রের রাজনীতি এবং অপরাধে তাঁদের জড়িত হওয়ার যেসব বিবরণ পাওয়া যায়, তা রীতিমতো আতঙ্কজনক। হত্যার ছাড়পত্র বা লাইসেন্স টু কিল বলে যে কথাগুলো এত দিন আমরা শুধু ইংরেজি সিনেমা কিংবা রহস্য উপন্যাসেই পড়ে এসেছি, এ মামলা তারই সাক্ষ্য দেয়।
ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত গণতন্ত্রে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো অপরিসীম ক্ষমতা এবং সম্পদের অধিকারী। ওই সব দেশে নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি স্পর্শকাতর। কিন্তু সেসব দেশে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। আমেরিকায় সিআইএ ও ব্রিটেনে এমআই ফাইভের প্রধানদেরও নিয়মিত পার্লামেন্টারি কমিটিতে হাজিরা দিয়ে নানা বিষয়ে জবাবদিহি করতে হয়। তার কোনোটা হয় রুদ্ধদ্বার শুনানিতে, কোনোটা হয় উন্মুক্ত সভায়। রাজনীতিতেও তাঁদের নাক গলানোর কোনো সুযোগ থাকে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ রায়ের তাৎক্ষণিক প্রভাবে যেটুকু অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, বিচারিক প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা যাতে আর না বাড়ে—সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। তবে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের দিকে নজর দেওয়া দরকার। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা যেমন কোনো গণতন্ত্রে কাম্য নয়, তেমনি রাজনীতিতে রাজনীতিকদের বাইরে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্য কারও নাক গলানো গ্রহণযোগ্য নয়।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক