জিয়াউর রহমান দেশের ইতিহাসে আলোচিত শাসকের নাম। একই সঙ্গে তিনি নিন্দিত ও নন্দিত। আজ ৩০ মে এই সাবেক রাষ্ট্রপতির ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে মোটাদাগে বড় অভিযোগ দুইটি। স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতির সুযোগ দেওয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা। এসব অভিযোগ ও সমালোচনা থাকার পরও দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এক শাসক তিনি। বিএনপিও অন্যতম প্রধান দল। দলটির তেমন সাংগঠনিক দক্ষতা ও শক্তি বর্তমানে নেই। কিন্তু নানা জুলুম, নির্যাতন ও চাপের মুখেও দলটি এখনো টিকে আছে। জনসাধারণের বড় একটি অংশই দলটিকে সমর্থন করে।
রাজনীতির এক জটিল ও চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার দৃশ্যপটে চলে আসেন। তখন একটি বড় প্রশ্ন ছিল যে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন কিনা। ১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ঐতিহাসিক গওহর আলী মন্তব্য করেছিলেন, জিয়া সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিলেও শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। ওই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন, সামরিক বাহিনী মূলত চার ভাগে বিভক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী ও রক্ষীবাহিনী থেকে আসা অংশ, জিয়ার অনুসারী, পাকিস্তান প্রত্যাগত অংশ ও জাসদপন্থী দল। সব সামলে জিয়া এক ধরনের স্থিতিশীলতা এনেছিলেন।
এ রকম নানা ধারণা, প্রশ্ন, সমালোচনা, প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র সবকিছু সামলে নিয়েই প্রায় পাঁচ বছর দেশ শাসন করেছেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে দুইভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত, ৭০ দশকের আর দশজন সামরিক শাসকের মতোই তিনি কঠোর ও কৌশলী। প্রথম দিকে প্রতিপক্ষকে কঠোরভাবে দমন করেন। সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাঁর সময়। এর পাশাপাশি তিনি কিছু গণমুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন যা জনসাধারণকে আকৃষ্ট করেছিল। খাল খনন কর্মসূচি এর অন্যতম। ওই সময় তিনি দেড় হাজারের বেশি খাল খনন ও পুনঃখনন করেছিলেন। যার অর্থনৈতিক সুফল জনসাধারণ পেয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ সালে খাদ্য শস্য রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদিত হয়। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ছাড়া গণশিক্ষা কার্যক্রম, গ্রাম সরকার, গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনী গঠনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি জনসাধারণকে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদেরও শরিকানা আছে। তৃণমূলকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি পোশাক রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানোরও উদ্যোগ জিয়া সরকারের আমলেই নেওয়া হয়। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি তার আমলেই শুরু হয়।
সামরিক শাসকদের খুবই সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে ক্ষমতা দখলের পরই চটকদার কিছু কর্মসূচি বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে শুরু জনসাধারণকে গণতন্ত্রের দাবি থেকে সরিয়ে রাখা। কিন্তু জিয়াউর রহমান এখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তার সময়ে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষেই জনসাধারণের জন্য সুফল এনেছিল। এখন দেশে বৃহৎ ওয়াটার রিজার্ভার বা পানি সংরক্ষণাগারের কথা বলা হয়। খাল খনন এই ওয়াটার রিজার্ভারেরই ৭০ দশকের রূপ।
তিনি অনেককেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাছে টানতে পেরেছিলেন। গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদের ‘বিএনপির সময় অসময়’ (প্রথমা প্রকাশনী) বই থেকে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ বিভিন্ন সময় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন। দেশের প্রধান বাম দল সিপিবি খাল খনন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। সাবেক মন্ত্রী ও সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের পিএইচডির অভিসন্দর্ভ খাল খনন কর্মসূচি নিয়ে করা। ড. ইউনুসকে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি শুরু করতে সহায়তা করেছিলেন জিয়া। আইসিডিডিআরবি প্রতিষ্ঠিত হয় সেসময়।
জিয়াউর রহমানের আমলে ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজির পরিবর্তে বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিকাশ ঘটে। ব্র্যাক, প্রশিকাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বড় পরিসরে কাজ শুরু করে। মজার বিষয় হচ্ছে, যারা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে ছিলেন, পরবর্তীতে সবাই জিয়াউর রহমানকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ওয়েবসাইট বা কোথাও ক্ষুদ্রঋণের বিষয়ে জিয়াউর রহমানের সহায়তার তথ্য পাওয়া যায় না।
পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসেন জিয়া। পররাষ্ট্রনীতিতে তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি ও সার্ক গঠন। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতকে এককভাবে মোকাবিলা করা দুষ্কর ছিল। এই অবস্থায় তিনি অন্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে চেয়েছিলেন। ভারতের বিরোধিতার মুখে সার্কের উদ্যোগ নেওয়া সহজ ছিল না। আর ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে জাতিসংঘের অভিযোগ দাখিল করা ছিল অত্যন্ত সাহসিকতার বিষয়।
রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাঁর সময়েই বহুদলীয় রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর সময়েই ভারতে নির্বাসন থেকে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। আবার স্বাধীনতার পরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামসহ বেশ কয়েক’টি ইসলামি দল সেসময়েই আবার রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা মানুষ গ্রহণ করেছিল। জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জায়গায় তিনি রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ নিয়ে আসেন।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও সামরিক শাসনামলে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত সামরিক সরকারের কোনো দল খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়। এই দলগুলো দীর্ঘদিন টিকেও থাকে না। সামরিক শাসকের বিদায়ের পর দলগুলোরও বিলুপ্তি ঘটে। নিকট অতীতে এ রকম উদাহরণ অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে এর বিপরীত ঘটেছে। গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ তার ‘বিএনপির সময় অসময়’ বইয়ে লিখেছেন, ‘বিএনপির জন্ম স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। এই অঞ্চলের দলগুলো সাধারণত রাজপথে, আলোচনার টেবিলে ক্ষমতার মঞ্চের বাইরে থেকে তৈরি হয়েছে। বিএনপি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা এক অরাজনৈতিক ব্যক্তি মনে করলেন তিনি রাজনীতি করবেন এবং দল গঠন করলেন।’ এবং এই দল এখনো দেশের অন্যতম বড় দল।
ক্ষমতার বলয়ে জন্ম নেওয়া একটি দল সমানতালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে। বিএনপিকে অনেকেই রাজনৈতিক ক্লাব বলতে পছন্দ করেন। এখানে নাম মত ও পথের দল থেকে আসা নেতারা মন্ত্রী হয়েছেন। সরকারের সুবিধা নিয়ে ব্যবসা করেছেন। কিন্তু তাঁরা দলকে ধারণ করেননি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাষ্ট্রপতি লে.জে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে। বিএনপির অনেক নেতা হুমড়ি খেয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিতে শুরু করেন। বিগত জরুরি অবস্থার সময়ও দলটির মহাসচিবসহ শতাধিক এমপি সংস্কারপন্থী হয়েছিলেন। তারপরও জিয়ার মৃত্যুর পর নেতৃত্বহীনতা ও নানা ঝক্কি-ঝামেলার পরও দলটি ভালোভাবেই টিকে গিয়েছে।
জিয়াউর রহমানকে নানাভাবে চিত্রায়িত করা হয়। বিএনপি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যেই আটকে আছে। অন্যদিকে ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী বা আড়ালের মদদদাতা মোশতাকের সময় সেনা প্রধানের পদে আসা, ক্যু দমনের নামে সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যার অভিযোগ করেন জিয়াউর রহমানের সমালোচকেরা। এত সমালোচনা ও নিন্দামন্দের পরও জিয়াউর রহমান ও তার দল বিএনপির প্রতি বড় একটি অংশের সমর্থন আছে। এর কারণ কি? এই প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তর হতে পারে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। যে পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্সের ওপর দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে, তার শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলেই। ইতিহাসের আতশি কাচের নীচে ফেলে যদি জিয়াউর রহমানকে বিশ্লেষণ করা হয় তবে নেতিবাচক কাজের পাশাপাশি তাঁর অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলোও বেরিয়ে আসবে। নানা অভিযোগ থাকার পরও অর্থনৈতিক কর্মসূচি দিয়েই জিয়াউর রহমান সম্ভবত উতরে গিয়েছেন।
ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।