ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও সুবোধ ঋণগ্রহীতা
বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা ও সমালোচনা হয় এবং হচ্ছে, অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের কোনো বিষয় নিয়ে এতখানি কখনোই হয় না। বিষয়টি এমনই দাঁড়িয়েছে, এই ক্রমাগত আলোচনা ও উদ্বেগ এত খোলামেলাভাবে প্রকাশিত যে আজকাল তা সাধারণ মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই সড়ক দুর্ঘটনায় অপমৃত্যুর মিছিল যে রকম সবার গা-সওয়া হয়ে গেছে, ব্যাপারটা তেমনই। অতিসম্প্রতি জাতীয় সংসদে দেশের শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির নামের তালিকা প্রকাশ করার পর বিষয়টি আবারও শীর্ষ খবরে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে নামগুলো অপরিচিত নয়, তাদের খেলাপি তথ্যও অজানা নয়, বরং তালিকায় অনেক নামের অনুপস্থিতি তাঁদের বিস্মিত করেছে।
খেলাপি ঋণের বিষয়টি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পর্যন্ত গড়ানোর পর মানুষ জানতে পারে, দেশে ১০ হাজার ৪৭৬টি হিসাবের বিপরীতে নেওয়া খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা মামলা করে আটকে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এই পরিমাণ ঋণ খেলাপি, তবে আদালতের নির্দেশে আপাতত তাদের খেলাপি বলা যাবে না। তা ছাড়া, এর মধ্যে রয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা ঋণ, যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। অবশ্য খেলাপিদের পক্ষাবলম্বনকারী কারও কারও মতে, বিশাল অঙ্কের এই খেলাপি ঋণের পরিমাণের বড় অংশই হচ্ছে আরোপিত সুদ। এই যুক্তির মাধ্যমে তাঁরা হয়তো বোঝাতে চান যে সুদ বা মুনাফার অংশ তো শোধ করতে হয় না, সুতরাং সেটা বাদ দিয়েই খেলাপি ঋণের হিসাব করা উচিত। কিন্তু ঋণের ওপর আদায় করা সুদ থেকেই যে আমানতকারীদের সুদ বা মুনাফা দেওয়া হয়, সেটি এই যুক্তির মধ্যে অনুপস্থিত।
স্মর্তব্য, শীর্ষ খেলাপিদের নামের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করার নজির এবারই প্রথম নয়। ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান প্রথমবারের মতো শীর্ষ ১০০ খেলাপির নাম জাতীয় সংসদে প্রকাশ করেছিলেন। তার প্রায় দুই দশক পর ২০০৯ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দ্বিতীয়বারের মতো প্রকাশ করেছিলেন ঋণখেলাপিদের তালিকা। এই তালিকায় ছিল এমন শীর্ষ খেলাপিদের নাম, যাদের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছরের মাথায় বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ৩০০ খেলাপির নাম প্রকাশ করেন, যাদের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা।
৩০ বছরের মধ্যে তিনবার খেলাপি গ্রহীতাদের নামের তালিকা প্রকাশের ‘সুফল’ খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত ব্যাংক খাত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। গত ১০ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র অনুযায়ী ২২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০১৮ পর্যন্ত ৯৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত ১০ বছরের খেলাপি ঋণের একটি ছক থেকে দেখা যায়, ২০১৩ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। তার কারণ স্পষ্ট। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঋণ পুনঃ তফসিল করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার সুযোগে বহু ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। এবারও যে নীতিমালার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটি উচ্চতর আদালতের হস্তক্ষেপে আপাতত স্থগিত আছে। তবে এই চেষ্টাগুলোকে আমরা প্লাস্টিক সার্জারি হিসেবে ধরে নিতে পারি।
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে কাদের চিহ্নিত করা হবে, তার কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। এই সংজ্ঞা নির্ধারণ করা না হলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে না। উল্লেখ্য, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (আরবিআই) ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় নীতিমালা জারি করেছে প্রায় ১০ বছর আগে। আমরা ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনেক শিক্ষা নিলেও এ বিষয়ে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি। বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, তাহলে আরবিআইয়ের সংজ্ঞাটা আমাদের দেন না কেন? বলা বাহুল্য, যাঁরা এই উষ্মা প্রকাশ করেছেন, তাঁরা সবাই ঋণখেলাপি।
ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে সেসব গ্রহীতাকেই সংজ্ঞায়িত করা যাবে: ১. যারা সাধ্য থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করেনি; ২. যারা গৃহীত ঋণ নির্দিষ্ট খাতে ব্যবহার না করে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করেছে; ৩. যাদের ঋণের অর্থ নির্দিষ্ট ব্যবসায় ব্যবহার না করে সরিয়ে ফেলার পর গৃহীত ঋণের অর্থ সেই প্রকল্প বা ব্যবসার বাইরে ভিন্নতর কোনো সম্পদ হিসেবেও অস্তিত্বশীল নেই এবং ৪. যারা ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংকের অজ্ঞাতসারে সরিয়ে ফেলেছে।
এই নীতিমালার অপব্যবহার যাতে না হয়, সে লক্ষে্য ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে, যাতে কোনো একক ঘটনা বা লেনদেনের ওপর ভিত্তি না করে গ্রাহকের অতীত লেনদেন ও আচরণ বিবেচনায় নিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা হয়।
কোনো ধরনের সংশয় নিরসনে ঋণের অর্থ অন্যত্র ব্যবহার (ডাইভারশন) বা পাচারের সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা হয়েছে এই নীতিমালায়। এই ডাইভারশন বা পাচারের সংজ্ঞা হবে এ রকম: ১. গৃহীত ঋণ থেকে স্বল্পমেয়াদি চলতি মূলধন দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করা; ২. মূল প্রকল্পের বাইরে ভিন্ন কোনো সম্পদ আহরণে ব্যয় করা; ৩. যেকোনো উপায়ে গ্রুপের অন্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা; ৪. ভিন্ন কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা ইত্যাদি।
গৃহীত ঋণের অর্থ পাচারের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, কোনো গ্রহীতা যদি ঋণকৃত অর্থ তার ব্যবসা বা শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করে এবং তার জন্য যদি কোম্পানি বা ব্যাংক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেটাকে পাচার হিসেবে গণ্য করা যাবে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৯৯৯ সাল থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংজ্ঞায়িত করা শুরু করে। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সংযোজন ও সংশোধনের পর ২০১৫ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। আমরা এটি চাইলে গ্রহণ করতে পারি।
আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের কারণ হিসেবে উপরিউক্ত লক্ষণগুলো দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেও একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালার অভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং কেবল খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জুতসই অস্ত্রও ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া উচিত। যদিও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটা সরকারকেই নিতে হবে, যে রকম চীনসহ অন্য দেশে নেওয়া হয়েছে।
ঋণখেলাপিদের ৯ শতাংশ হারে সুদ আরোপ করার পাশাপাশি সুবোধ ঋণগ্রহীতাদের যে প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটিও বৈষম্যমূলক। ২০১৫ সালে সুবোধ গ্রহীতাদের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল ব্যাংকগুলো তাদের সুবোধ ঋণগ্রহীতাদের আদায় করা সুদের ১০ শতাংশ ফেরত দেবে। আমরা এই নির্দেশনার মূল চেতনা ধরে এগিয়ে গেলে বুঝতে পারি কোন উদ্দেশে এই সার্কুলার জারি হয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান ব্যাংক খাতের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংখ্যক ব্যাংকের উপস্থিতিতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে বাধ্য হয়। সেই প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যাংক থেকে অনুমোদিত অথচ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণসীমা থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়ে প্রথমোক্ত ব্যাংকের ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে শোধ করে দিতে পারলে তাকে কি সুবোধ গ্রহীতা বলা যাবে? নাকি যে ঋণগ্রহীতা তার বিক্রিলব্ধ আয় থেকে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে যাবে, তাকেই বলা যাবে সুবোধ ঋণগ্রহীতা?
সুতরাং উপরিউক্ত প্রেক্ষাপটে তথাকথিত সুবোধ ঋণগ্রহীতাদের জন্য দেওয়া ছাড় প্রকৃতপক্ষে এই বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টির প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা অসংগত হবে না বলে বোধ করি। মধ্যম ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর রেখে সুবোধ ঋণগ্রহীতাদের সুদহার ছাড় দেওয়ার যে নীতিমালা আছে, সেটির শর্তগুলো পরিবর্তন করার সময় এসেছে। কারণ, সুবোধ ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞা দিনে দিনে পরিবর্তিত হয়েছে, বদলেছে তাদের মনোভাব, বদলেছে তাদের প্রতি সরকারের অবস্থানও। কিন্তু ব্যাংকগুলো তো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারবে না। সুতরাং সরকারকেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে, যাতে ব্যাংক খাত উপকৃত হয়। কারণ, একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত না থাকলে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি শুধু হোঁচটই খাবে না, তার গতি রুদ্ধ হবে।
ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার