২০১৪ থেকে ২০২২, ইউক্রেন বিষয়ে পশ্চিমাদের ভাবনা কী ছিল? কী ছিল তাদের উল্লেখ করার মতো পদক্ষেপ? উত্তর জানা না থাকলেও চলবে। কারণ, পশ্চিমা দেশগুলো গত আট বছরে ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে কিছুই করেনি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হওয়ার দিন থেকে আজ পর্যন্ত ইউক্রেনের রাজনীতি ইউরোপপন্থী আর রাশিয়াপন্থী—এই দুই মেরুতে ভাগ হয়ে আছে।
পুতিনের মতে, রাশিয়ান আর ইউক্রেনিয়ানরা এক ও অভিন্ন। ইউক্রেনীয়দের যারা রাশিয়া থেকে আলাদা করতে চায়, তারা নয়া নাৎসি। ইউক্রেন বিষয়ে রাশিয়ার এ রকম ন্যারেটিভ কিন্তু একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। ২০১০ সালের ইউক্রেনে ঘটে যাওয়া নির্বাচন কিন্তু সে কথাই বলে। সেই নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং স্বচ্ছ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন রাশিয়ান সমর্থনপুষ্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এই নির্বাচন এবং সামান্য ব্যবধানে বিজয় বুঝিয়ে দেয় ইউক্রেনীয়রা আদতেই ভাগের মানুষ। তাদের আলাদা করেছে ভাষা। ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কথা বলে রাশিয়ান ভাষায়। আর ইউক্রেনিয়ানভাষী মানুষের বসবাস সাধারণত পশ্চিম ও মধ্যভাগে।
ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ কতটা রাশিয়াভক্ত, এর প্রমাণ দিয়েছিলেন ২০১৩ সালের নভেম্বরে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ইউক্রেনের একটা সমঝোতা চুক্তি হওয়ার কথা ছিল সেবার। কিন্তু ইয়ানুকোভিচ সম্মেলনের মাঝপথেই বেরিয়ে যান। কিয়েভে শুরু হয় বিক্ষোভ। তাঁকে আশ্রয় নিতে হয় রাশিয়ায়। শুরু হয় ইউক্রেনে রাশিয়ান অধ্যায়। ক্রিমিয়ার দখলের দুই সপ্তাহের ভেতর রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীরা দখল করে দনেস্তক ও লুহানস্ক।
এ হলো আট বছর আগের ইতিহাস। আপাতদৃষ্টিতে পুতিনের বর্তমান পরিকল্পনা হলো ক্রিমিয়ার সঙ্গে দনেস্তক ও লুহানস্কের সংযোগ ঘটানো। এ সংযোগের ফলে জন্ম নেবে রাশিয়া-সমর্থিত নতুন ছায়ারাষ্ট্র। কারণ, পুতিন জানেন, আজ অথবা কাল ইউক্রেনীয়রা ইইউতে যোগ দেবেই। সাম্প্রতিক এক জরিপ তেমনটাই বলে। বিবিসির মতে, ৬৮ শতাংশ ইউক্রেনিয়ান ইইউতে যোগ দিতে চান। ইইউতে যোগ দেওয়াটা ইউরোপের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য লটারি জেতার মতোই। কোনো মতাদর্শই এখানে কাজ করে না। প্রমাণ হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ড। কমিউনিস্ট-শাসিত এই তিন দেশই এখন ইইউর সদস্য।
ইউরোপের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর কিন্তু রাশিয়ার বিষয়ে ভিন্ন নীতি। অনেকটা ‘রাশিয়া অধম বলিয়া আমি উত্তম রাশিয়ার সঙ্গ লইব না কেন?’ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমের নর্ড স্ট্রিম গ্যাসের ওপর ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর নির্ভরতার কথা বুড়ো থেকে শিশু, সবাই জানে। জার্মানি যদিও নর্ড স্ট্রিম-২-এর কাজ আপাতত স্থগিত করেছে, কিন্তু নর্ড স্ট্রিম-১-এর বিকল্প জার্মানির জানা নেই। আর রাশিয়ান সরকারও এসব বিষয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে সব সময়। তারা বিভিন্ন প্রকল্পে ইইউভুক্ত দেশের সাবেক মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীদের নিয়োগ দিয়েছে।
এসব তথ্য থেকে মনে হতেই পারে রাশিয়া অধম। রাশিয়াকে কেউই চায় না। ইউরোপের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর কিন্তু রাশিয়ার বিষয়ে ভিন্ন নীতি। অনেকটা ‘রাশিয়া অধম বলিয়া আমি উত্তম রাশিয়ার সঙ্গ লইব না কেন?’ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমের নর্ড স্ট্রিম গ্যাসের ওপর ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর নির্ভরতার কথা বুড়ো থেকে শিশু, সবাই জানে। জার্মানি যদিও নর্ড স্ট্রিম-২-এর কাজ আপাতত স্থগিত করেছে, কিন্তু নর্ড স্ট্রিম-১-এর বিকল্প জার্মানির জানা নেই। আর রাশিয়ান সরকারও এসব বিষয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে সব সময়। তারা বিভিন্ন প্রকল্পে ইইউভুক্ত দেশের সাবেক মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীদের নিয়োগ দিয়েছে।
এ তালিকায় আছেন সাবেক ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ফ্রানকোয়িস ফিলন, (রাশিয়ার সবচেয়ে বড় কেমিক্যাল প্রস্তুতকারক সিবুরে), ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এসকো আহো (রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাংক ‘এসবরব্যাংক’ এর অন্যতম পরিচালক), ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজি (রাশিয়ার সবচেয়ে বড় কার শেয়ারিং সার্ভিস ডেলিমবিলের পরিচালক), অস্ট্রিয়ার সাবেক চ্যান্সেলর ক্রিস্টিয়ান কার্ন (রাশিয়ার সরকারি রেল কোম্পানি আরজেডডির পরিচালক), জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর গের্হাড শ্রয়েডর (তাঁর বিষয়ে আলাদা করে বলতে হবে)। শেষের জন ছাড়া যদিও ওপরের সবাই যে যাঁর পদ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। অস্ট্রিয়ার আরেক সাবেক চ্যান্সেলর ওলফগ্যাং শুইসেল, যিনি রাশিয়ান কোম্পানি লুকয়লের অন্যতম পরিচালক এবং তিনি তাঁর পদ থেকে পদত্যাগ করবেন না বলে জানিয়েছেন। একই পথ ধরেছেন অস্ট্রিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কারেন কেনেইসল। আঁকড়ে আছেন রজনেফটের পরিচালক পদ। আর থাকবেনই না কেন? পুতিনের সঙ্গে কারেনের সম্পর্ক এতটাই মধুর যে ২০১৮ সালে পুতিন কারেনের বিয়েতে তাঁকে নিয়ে নেচেছিলেন।
কিন্তু ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলরের দায়িত্বে থাকা ৭৭ বছর বয়সী গের্হাড শ্রয়েডর পুতিনের সমর্থনে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি রজনেফটের অন্যতম পরিচালক। তিনি নর্ড স্ট্রিম-২ প্রজেক্টর শেয়ার হোল্ডার কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শ্রয়েডর তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। বলেছেন, দুই পক্ষই ভুল করেছে এবং ইউরোপের উচিত হবে না রাশিয়ার সঙ্গে যতটুকু সম্পর্ক আছে তাও ছেদ করা। শ্রয়েডরের মতো রাশিয়ার সমর্থনে আরও অনেক সাবেক ও বর্তমান রাজনীতিকও আছেন। কেউ রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি ফায়দা নিচ্ছেন। কেউ নিচ্ছেন কিছুটা রেখেঢেকে।
ব্রেক্সিটে ভোট জিততে বরিস জনসন রাশিয়ান প্রোপাগান্ডা সমর্থন নিয়েছিলেন। তা নিয়ে তদন্তও হয়েছিল। যদিও সেই তদন্ত নিয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। বরিসের কনজারভেটিভ পার্টির অন্যতম অর্থের উৎস রাশিয়ান ‘অলিগাক’রা (অলিগাক প্রাচীন গ্রিক শব্দ। এর দ্বারা এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি পরিবারের কাছ থেকে অফুরন্ত সম্পদ পেয়েছেন এবং যাঁর অনেক ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে)। যদিও যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী কোনো বিদেশি দেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে অর্থ সাহায্য করতে পারে না। কিন্তু রাশিয়ান অলিগাকদের আছে দ্বৈত নাগরিকত্ব। এই আইনি ফাঁক গলে তাঁরা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। ইলেকটোরাল কমিশনের হিসাব অনুযায়ী বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তার দল ও দলের এমপিদের চাঁদা হিসেবে পাওয়া প্রায় ১ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন পাউন্ড অর্থের উৎস হয় রাশিয়া কিংবা রাশিয়ান ব্যবসায়ী।
স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা ইয়ান ব্ল্যাকফোর্ড গত সপ্তাহেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বলেছেন, বরিসের দল রাশিয়ান অলিগাকদের কাছ থেকে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ সাহায্য নিয়েছে। তাঁদের ভেতর সবচেয়ে বড় অঙ্কের চাঁদাদাতার নাম লুবভ চেরনুখিন। এই রাশিয়ান ভদ্রমহিলা একাই দিয়েছেন সাত লাখ পাউন্ড। তিনি ভ্লাদিমির চেরনুখিনের স্ত্রী। ভ্লাদিমির চেরনুখিন ছিলেন পুতিনের সাবেক সহকারী অর্থমন্ত্রী। ভ্লাদিমির চেরনুখিনের নাম প্যান্ডোরা পেপারসে এসেছিল। ২০০৪ সালে তিনি রাশিয়া ছাড়েন ৩৬৬ মিলিয়ন পাউন্ড সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে। লুবভ চেরনুখিন বরিস জনসনের সঙ্গে ২০২০ সালে টেনিস খেলার নিলামে অংশ নিয়ে জিতেছিলেনও। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি) রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি রজনেফটের ২০ ভাগ অংশীদার, যার অর্থমূল্য কয়েক বিলিয়ন পাউন্ড।
রাশিয়ার গ্যাসের পয়সা, তেলের পয়সা এভাবেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইউরোপের আনাচকানাচে। বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদের পকেটে পকেটে। অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক অবরোধ—কোনো কিছুতেই রাশিয়ার তাই এখন খুব একটা কিছু আসে-যায় না আর। কারণ, পশ্চিমারা কখনোই এই দিনের জন্য তৈরি ছিল না। কিন্তু রাশিয়া প্রস্তুতি নিচ্ছিল অন্তত এক দশক ধরে। প্রমাণ ক্রেমলিনের অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রদানের নীতি। অন্তত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়া তার অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রদানের ব্যবস্থায় সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুবই সীমিত আকারে ঋণ দিয়েছে। এই সাবধানী পদক্ষেপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জমিয়েছে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক সম্পদের সঞ্চয়।
রাশিয়া পশ্চিমাদের কাছ থেকে যত দূরে সরেছে, পশ্চিমারা ততই রাশিয়াকে আঁকড়ে ধরেছে। এই বন্ধন এতটাই মজবুত যে ‘সব দোর কোরো না বন্ধ’ ধুয়া তুলে খোদ জার্মানিই চায় না রাশিয়াকে ‘সুইফট’ থেকে বাদ দিতে। কারণ, তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলার করে হয়তো ইউরোপের বাজারে তেলের ঘাটতি কমানো যাবে। কিন্তু গ্যাস? রাশিয়ার গ্যাস না জ্বললে শীতে মরতে হবে অনেক ইউরোপিয়ানের। তা ছাড়া সুইফটের বিকল্পও জানা আছে রাশিয়ার। আর তা হলো চায়নিজ সরকারের তৈরি করা ‘ক্রস বর্ডার ইন্টার ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম’ (সিপস)।
রাশিয়াকে ইউরোপের কেউ বিশ্বাস করে না। রাশিয়া তা জানে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এখনো ফিনল্যান্ডের প্রতিটি আবাসিক-অনাবাসিক স্থাপনায় বাংকার বানানো হয়। কারণ, রাশিয়ার বোমার ভয়। রাশিয়া ইউরোপের কাছ থেকে, পশ্চিমাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব চায়। এর জন্য যেকোনো মূল্য পরিশোধে তারা রাজি। কিন্তু ইউরোপের আপাতত রাশিয়াকে পাশে প্রয়োজন; ন্যাটোর স্বার্থে নয়। ইউক্রেনের স্বার্থে তো নয়ই। শুধু জ্বালানির স্বার্থে, হয়তো আরও না-জানা ব্যক্তিগত স্বার্থে।
আর তাই রাশিয়ার সঙ্গে পারতে হলে স্বার্থসংক্রান্ত এসব লেনদেন পুরোপুরি ত্যাগ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে রাশিয়ান গ্যাস কেনা, তেল কেনা। রাশিয়াকে বাদ দিতে হবে সুইফট থেকে। এসব নান উদ্যোগ নিলে হয়তো রাশিয়ার সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে। কিন্তু রাশিয়ার পয়সায় যেসব রাজনৈতিক নেতার ভোগ-বিলাস চলছে, তাঁরা আদতে ইউরোপকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিততে দেবেন কি?
রিনভী তুষার লেখক, রাজনীতি গবেষক ও যুক্তরাজ্যে কর্মরত অভিবাসন উন্নয়নকর্মী
[email protected]