যুদ্ধের কারণে কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তান থেকে তাড়া খেয়ে বাদামি চামড়ার যে আফগানরা ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন, তাঁদের ঢুকতে না দিয়ে নির্মমভাবে সীমান্ত থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কাজটি ইউরোপীয় দেশগুলো করে এসেছে। সেই ইউরোপে এক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার সহিংস আগ্রাসনের মুখে পড়ে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে এসেছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। মোটা দাগে সবাই জানে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে উদ্বাস্তুদের যেভাবে স্বাগত জানানো উচিত, তেমন করেই তাদের স্বাগত জানানো হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়েও ইউরোপের বর্ণবাদী দ্বিচারিতার মুখোশ খুলে গেছে।
ইউক্রেনের সীমান্তসংলগ্ন দেশটি লাখ লাখ ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুকে উষ্ণ সমাদরে গ্রহণ করেছে। অথচ মাস কয়েক আগেও আফগান শরণার্থীদের মুখের ওপর তারা দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। পোল্যান্ডের সরকারি নিরাপত্তাকর্মী ও সেখানকার মানুষ বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। ইউক্রেন থেকে তাড়া খেয়ে আসা মানুষগুলোর মধ্যে যাদের গায়ের রং ইউরোপীয়দের মতো নয়, তাদের তারা ঢুকতে দিতে চাইছে না।
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে জানা গেলে, কয়েক দিন আগে ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে ঢোকার সময় তিনজন ভারতীয় নাগরিককে পোল্যান্ডের পাঁচ ব্যক্তি বেদম পিটিয়েছে। তিনজনের মধ্যে একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আফ্রিকা থেকে ইউক্রেনে পড়তে যাওয়া বহু ছাত্রছাত্রী উদ্বাস্তু দলে আছে। পোল্যান্ড সীমান্তে সাদাদের ঢুকতে দেওয়া হলেও তাদের আটকে দেওয়া হয়েছে। পোল্যান্ডের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা তাদের সীমান্তে ‘হোয়াইটস অনলি’ লেখা একটা বিলবোর্ড টাঙিয়ে দিলেই পারত।
এটি শুধু যে পোল্যান্ডের ক্ষেত্রে হচ্ছে, তা নয়। আরব অ্যান্ড মিডল ইস্ট জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমে কর্মরত মার্কিন সাংবাদিক চার্লি ডি আগাথাসহ অনেক পশ্চিমা সাংবাদিককে প্রকাশ্যে বর্ণবাদী ভাষা ব্যবহারের নিন্দা করেছে। ডি আগাথা সম্প্রতি ইউক্রেন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এটি কয়েক দশক ধরে সংঘাতের মুখে থাকা ইরাক অথবা আফগানিস্তানের মতো কোনো জায়গা নয়।’ কিয়েভ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘এই শহর অপেক্ষাকৃত সভ্য, অপেক্ষাকৃত ইউরোপিয়ান।’ তিনি কোনো রকম রাখঢাক না করে ইরাক ও আফগানিস্তানের মানুষকে ইউরোপের তুলনায় অসভ্য বলেছেন।
গত বছর তালেবান আফগানিস্তান দখল করার পর আফগান শরণার্থীদের সঙ্গে পশ্চিমারা কী নির্দয় আচরণ করেছে, তা সবাই দেখেছে। দ্বিমুখী ছবি দেখা যাচ্ছে ইউক্রেন সীমান্তে। সেখানে সাদা চামড়ার মানুষকে যত সহজে গ্রহণ করা হচ্ছে, কালো বা বাদামি চামড়ার মানুষকে ততটাই অবজ্ঞায় ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক মনোভঙ্গি আরও খোলাসা হয়ে পড়ছে।
বোস্টনে অবস্থিত নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির দর্শন বিষয়ের অধ্যাপক সেরিনা পারেখ সম্প্রতি আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘মানুষের সহজাত স্বভাবই হলো সে যে মানুষকে তার মতো ভাবে তাকে তার আপন মনে হয়, যাকে তার নিজের মতো মনে হয় না, তাকে সে দূরের মানুষ মনে করে।’ ঠিক এ কারণে সংবাদপত্র কিংবা সংবাদভিত্তিক রেডিও-টেলিভিশনের বার্তাকক্ষে নানা বর্ণ ও নানা সমাজ থেকে আসা সংবাদকর্মীকে নিয়োগ করা উচিত।
‘নো রিফিউজি: এথিকস অ্যান্ড দ্য গ্লোবাল রিফিউজি ক্রাইসিস’ এবং ‘রিফিউজিস অ্যান্ড দ্য এথিকস অব ফোর্সড ডিসপ্লেসমেন্ট’ শিরোনামে সেরিনা পারেখের দুটি গবেষণাধর্মী বই আছে। পারেখ বলেছেন, সম্প্রতি ইউক্রেন থেকে যাওয়া শরণার্থীদের গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ইউরোপ যে ঔদার্য দেখাচ্ছে, তা সমর্থন করতে গিয়েও অনেকেই বর্ণবাদী মনোভঙ্গি প্রকাশ করছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইউরোপের ভাবটা এমন: ইউক্রেনের মানুষ সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধী নয়; সুতরাং আমরা তাদের কোনো রকম দুশ্চিন্তা ছাড়াই নিরাপদে গ্রহণ করতে পারি।’ এ ধরনের মনোভঙ্গি দিয়ে কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই একেকটি জাতি সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পশ্চিমা গণমাধ্যমের কল্যাণে নৈতিকভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা মানুষের কাছে এক মহান জননায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। অগণিত মানুষ (তাঁদের মধ্যে আমার অনেক ফেসবুক বন্ধুও রয়েছেন) জেলেনস্কির নায়কোচিত চরিত্র ও সাহসিকতা তুলে ধরতে সামরিক পোশাক পরে সেনাদের পাশে দাঁড়ানো তাঁর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেলেনস্কির রুখে দাঁড়ানোর ছবি তুলে ধরা হচ্ছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে যখন বাদামি চামড়ার মানুষ একই ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন সেই ছবি একইভাবে প্রচার পায় না।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এবং স্বাধীন সংবাদকর্মীরা বছরের পর বছর বলে যাচ্ছেন, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, সোমালিয়া এবং অন্য অনেক জায়গায় মার্কিন-এবং ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন যুদ্ধগুলোর পেছনে বর্ণবাদী মানসিকতাও বড় ভূমিকা রাখছে। সেখানে সংঘটিত মানবিক বিপর্যয়গুলোও নিষ্ঠুরভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বাদামি চামড়ার শরণার্থীদের গ্রহণ করলে তাদের উপস্থিতি পশ্চিমাদের আগ্রাসী অভিযানের প্রমাণ হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপিত হবে—এ ভাবনা থেকেও তাদের পশ্চিমা দেশে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
ইউক্রেনের শরণার্থীরা যদি রাশিয়ার নির্মমতার প্রমাণ হয়ে থাকে, তাহলে আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে প্রাণভয়ে আসা শরণার্থীরাও যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিষ্ঠুরতার বড় প্রমাণ। রাশিয়ার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের গ্রহণ করার ক্ষেত্রে স্পষ্টতই ইউরোপ দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করেছে। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই নির্দোষ নয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমগ্র আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের বিষয়ে তিনি কুৎসিত সব বর্ণবাদী কথা বলেছিলেন। জো বাইডেন গদিতে বসার পর তিনি ট্রাম্পের সেই শরণার্থী নিষিদ্ধের আইন তুলে দেন এবং শরণার্থীদের গ্রহণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। প্রথম কয়েক দিন তার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন দেখা গেলেও কিছুদিনের মধ্যেই শরণার্থী গ্রহণ বন্ধ করে দেন।
গত বছর তালেবান আফগানিস্তান দখল করার পর আফগান শরণার্থীদের সঙ্গে পশ্চিমারা কী নির্দয় আচরণ করেছে, তা সবাই দেখেছে। দ্বিমুখী ছবি দেখা যাচ্ছে ইউক্রেন সীমান্তে। সেখানে সাদা চামড়ার মানুষকে যত সহজে গ্রহণ করা হচ্ছে, কালো বা বাদামি চামড়ার মানুষকে ততটাই অবজ্ঞায় ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক মনোভঙ্গি আরও খোলাসা হয়ে পড়ছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● সোনালি কোলহাতকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক