ন্যাটোর ভবিষ্যৎ কী? বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার বা তালেবানদের হাতে পরাজয়ের পর ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা, এর কার্যকারিতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছিলেন। তাই ন্যাটোকে আবারও দৃশ্যপটে আনা জরুরি ছিল। প্রয়োজন ছিল নতুন যুদ্ধক্ষেত্র বা সংঘাতময় অঞ্চলে উত্তপ্ত, অস্থির পরিবেশের। আফগানিস্তান থেকে সরে গিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো কোথায় সক্রিয় হতে পারে বা যুদ্ধ শুরু করতে পারে, এ নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা ছিল। মার্কিনদের হাতে দুটি বিকল্প ছিল। প্রথমটি হচ্ছে পূর্ব ইউরোপ, আর দ্বিতীয়টি ছিল দক্ষিণ চীন সাগর।
খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। কোয়াড, অকাস, ইন্দো-প্যাসিফিক জোট—এমন বিভিন্ন সামরিক জোটের আলাপের ভেতর ম্লান হতে থাকা ন্যাটোকে বলা যায় পুনর্জীবন দান করল ইউক্রেন সংকট। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা নিয়ে বিস্তর আলাপ, বিশ্লেষণ হচ্ছে। কার লাভ হলো, ক্ষতি হলো, রাশিয়া কত দিন ইউক্রেন দখল করে রাখবে, নাকি পুতুল সরকার বসিয়ে বিদায় নেবে, এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে—এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। কিন্তু তালেবানের হাতে সদ্য পরাজিত হওয়া ন্যাটোর পুনরুত্থান নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না।
সাদা চোখে বিশ্লেষণ করলে ইউক্রেন সংকটের খলনায়ক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিনের বিরুদ্ধে মস্কোসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। যুদ্ধবিরোধীরা অবিলম্বে ইউক্রেনে আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। নিন্দা করেছেন দিনদুপুরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ দখল করার বিরুদ্ধে। কিন্তু বিশ্ব মোড়লেরা সবাই চেয়ে চেয়ে দেখল। রীতিমতো বলেকয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করল। এটা ১৬৪৮ সালে স্বাক্ষরিত ওয়েস্টফেলিয়ান ধারণার স্পষ্ট বরখেলাপ। উপরন্তু পুতিন ইউক্রেন দখলে জাতিসংঘের ধারা উল্লেখ করে রীতিমতো তামাশাই করলেন। যেমনটি মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া হামলার ক্ষেত্রে করেছে। সাধারণ নাগরিকদের রক্ষার কথা বলে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের পদ্ধতি অবলম্বন করেই ইউক্রেন দখলে নামল।
কিন্তু কেউই ইউক্রেনকে রক্ষা করতে এগিয়ে এল না। রাশিয়ার হামলার মুখে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি। ইউক্রেনকে রক্ষায় পশ্চিমাদের বা যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে আসার কথাও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন নিয়ে ভয়ংকর কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রথমত, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার টোপ ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত ছিল, রাশিয়া বাধা দেবে। রাশিয়ার প্রতিবেশী লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া ন্যাটোভুক্ত হয়েছিল ২০০৪ সালে। এর মধ্যে লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সীমানা রয়েছে, কিন্তু দীর্ঘ সীমান্ত নয়। ওই সময় রাশিয়া খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেনি। তবে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘ সীমানা রয়েছে। ফলে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের জন্য ইউক্রেনকে হাতে রাখা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ পথেই রাশিয়া সমুদ্র বাণিজ্যের সিংহভাগ সম্পন্ন করে। তাই কৃষ্ণ সাগরে ন্যাটোর জাহাজের উপস্থিতি রাশিয়ার জন্য কখনোই স্বস্তিদায়ক নয়।
কিন্তু কেউই ইউক্রেনকে রক্ষা করতে এগিয়ে এল না। রাশিয়ার হামলার মুখে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি। ইউক্রেনকে রক্ষায় পশ্চিমাদের বা যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে আসার কথাও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন নিয়ে ভয়ংকর কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রথমত, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার টোপ ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত ছিল, রাশিয়া বাধা দেবে। রাশিয়ার প্রতিবেশী লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া ন্যাটোভুক্ত হয়েছিল ২০০৪ সালে। এর মধ্যে লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সীমানা রয়েছে, কিন্তু দীর্ঘ সীমান্ত নয়। ওই সময় রাশিয়া খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেনি।
তাই বুঝেশুনেই যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার কার্ড খেলেছে। লক্ষ্য ছিল দুটি—ইউক্রেনকে হাতের মুঠোয় আনা, নতুবা ইউরোপে আরও শক্ত করে ঘাঁটি গেড়ে বসা। রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে ইউক্রেন স্বাধীনতা হারালে বা ন্যাটোভুক্ত না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লোকসান নেই। বরং রাশিয়ার ভয় দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা দূরে সরে যাওয়া ইউরোপকে আবারও নিজের বলয়ে আনতে পারবে। পাঁচ-ছয় বছর ধরেই ব্রিটেন বাদে ইউরোপের সঙ্গে ন্যাটোর সম্পর্ক খুব বেশি জমাট ছিল না আগের মতো। তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ব্যয়, সন্ত্রাসী হামলা এবং সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানের বিশালসংখ্যক উদ্বাস্তু নিজের ঘাড়ে তুলে ইউরোপের অবস্থা রীতিমতো কাহিল।
এ কারণে ন্যাটো থেকে সরে এসে নিজস্ব অবস্থান তৈরির চিন্তা জার্মানি ও ফ্রান্সের কথায় প্রতিফলিত হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় জার্মানির সদ্য সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের এক দফা বাহাসও হয়েছে এ নিয়ে। ইউরোপের নিরাপত্তার ঝুঁকি স্মরণ করিয়ে ট্রাম্প জিডিপির ২ শতাংশ ন্যাটোতে দিতে বলেছিল। জবাবে ম্যার্কেল বলেছিলেন, দশমিক ৫ শতাংশের বেশি দেওয়া সম্ভব নয়। এতে না পোষালে তিনি ন্যাটোকে চলে যেতে বলেছিলেন। প্রত্যুত্তরে ট্রাম্প জার্মানি থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথাও বলেছিলেন। ওদিকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও বিভিন্ন সময় বলেছেন, ইউরোপ নিজেই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল জার্মানি ও ফ্রান্সকে এ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসী অভিযান যুক্তরাষ্ট্রকে তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় ইউরোপকে মৌখিকভাবে রাশিয়ার ভয় দেখিয়েছে। এবার প্রামাণ্যভাবেই রাশিয়ার হুমকি ইউরোপকে দেখাতে পারবে। ইতিমধ্যেই পূর্ব ইউরোপসহ জার্মানিতে সাত হাজার সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইউরোপজুড়ে আবারও ন্যাটোর সাজ সাজ রব পড়ে যাবে। এস্তোনিয়া থেকে গ্রিস পর্যন্ত সামরিক ঘাঁটিগুলো ন্যাটোর সৈন্যদের আনাগোনায় আবারও মুখর হবে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সবদিক বিবেচনা করেই ইউক্রেন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লোকসান হয়নি। বরং আফগানিস্তানে বিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে। অপর দিকে রাশিয়ারও লোকসান হয়নি। বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় ধরে রেখে রাশিয়া সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার সক্ষমতা দেখিয়েছিল। ইউক্রেনেও আবার নতুন করে দেখাল। যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক এক মেরুভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তে বহু মেরুকেন্দ্রিক অবস্থার উন্মেষ ঘটছে বলে আলাপ প্রচলিত আছে। রাশিয়া নিজের পেশিশক্তি দেখিয়ে এ আলাপের পালে নতুন করে হাওয়া দিল।
ইউক্রেন সংকটে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ভালো অবস্থায় আছে। এ যুদ্ধে হেরেছে ইউক্রেন। রাজনীতিতে পূর্বানুমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাদের পূর্বানুমান মিলে যায়, তারা জয়ী হয়। আর যাদের হিসাব মেলে না, তারা পরাজিতদের কাতারে নাম লেখায়। ইউক্রেনের পূর্বানুমান মেলেনি। ন্যাটোর সদস্য হলে রাশিয়ার দিক থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, তা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বা নীতিনির্ধারকেরা অনুধাবন করেননি। ইউক্রেন অবশ্যই রাশিয়ার ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলবে, কিন্তু সেটা সংঘাত এড়িয়ে।
ইউক্রেনের জন্য নিরাপদ রাস্তা ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য হওয়া। পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ না পেলেও অন্তত ইউরোপীয় ইকোনমিক জোনের সদস্য হতে পারত। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে ইইউর সদস্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারত। ইইউর সদস্য পদ পেলে ন্যাটোর সদস্য হব, এ শর্ত দিলে যুক্তরাষ্ট্রই ইইউকে চাপ দিত। আর ইসরায়েল থেকে অথবা ইসরায়েলের মাধ্যমে অস্ত্র কিনে সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে পারত ইউক্রেন। এমনিতেই ইসরায়েলের সঙ্গে ইউক্রেনের ঐতিহাসিক সখ্য রয়েছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বসতি সম্প্রসারণে জেলেনস্কি প্রকাশ্যেই সমর্থন দিয়েছেন। ইইউর সদস্য ও ইসরায়েলের অস্ত্রের ক্রেতা হলে রাশিয়া ইউক্রেন হামলার আগে সতর্কভাবে চিন্তাভাবনা করত। ইসরায়েল থেকে অস্ত্র কিনতে বাধা দিলে রাশিয়া অ্যান্টিসেমেটিক হিসেবে ইসরায়েলি লবির তোপের মুখে পড়ত।
রাজনীতিতে আইডিয়ালিজম (আদর্শবাদ) থেকে আইডিয়া (ধারণা, মতামত, পরিকল্পনা) বেশি কাজ করে। রাজনৈতিক বাস্তববাদের অনুসারীরা আইডিয়ার ওপর নির্ভর করেন বেশি। আর উদারপন্থীরা আদর্শের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। রিয়েল পলিটিক আদর্শ বেশি ভূমিকা রাখে না। বরং রিয়েল পলিটিক বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপর ভর করে ভয়ংকর এক অবস্থায় নিয়ে যায় সমাজকে। অথবা ভয়ংকর নৈরাজ্যের ভেতর টিকে থাকতে চেষ্টা করে রাষ্ট্র। এ অবস্থায় কোনো রাষ্ট্র নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য যা করে, তা-ই যৌক্তিক। এ ধরনের পরিস্থিতি সমাজে যুদ্ধবিগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু লড়াইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে বিপর্যয় নিশ্চিত।
ইউক্রেন রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের রিয়াল পলিটিক নীতির শিকার। যাঁরা যুক্তরাষ্ট্র ঠিক করেছে, না রাশিয়া ঠিক করেছে—বলে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে কথার লড়াই করছেন, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বোকারা যুদ্ধে জেতে না, কুশলীরা জেতে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভুল পরিকল্পনা করেছিলেন। ভুলের মাশুল তিনি সার্বভৌমত্ব দিয়ে মেটাচ্ছেন। কিন্তু বাইডেন ও পুতিন দুজনই কুশলী। মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় পর্যায়ের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হলো। ইউক্রেনের পর জর্জিয়াকে ঘিরে নতুন সংকট সৃষ্টি হতে পারে। আবখাজিয়া অঞ্চলকে ঘিরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই দ্বন্দ্ব আছে। এ সংকট নতুন রূপ লাভ করতে পারে। রাশিয়ার সীমান্তে উত্তেজনা বাড়লে রাশিয়ার আগ্রাসনও বাড়বে। এর সরাসরি প্রভাব হিসেবে পূর্ব ইউরোপসহ ইউরোপে ন্যাটোর ঘাঁটি ও সৈন্যসংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে। ইউক্রেন হারলেও আপাতত রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষই জিতে যাবে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক