ইউক্রেনে সর্বাত্মক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন একটা গুরুত্বপূর্ণ রেখা লঙ্ঘন করে ফেলেছেন। ২০০৮ সালে রাশিয়া যখন জর্জিয়ায় আগ্রাসন চালিয়েছিল এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল, তখনো পশ্চিমারা বসে বসে দেখা ছাড়া কিছুই করেনি। কিন্তু রাশিয়া এখন ইউক্রেনের ওপর সর্বাত্মক যে আগ্রাসন শুরু করেছে, সেটা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। পুতিনের কর্মকাণ্ডে এ মুহূর্তে রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক কোনো আলোচনা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ২১ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্টের অসংলগ্ন বক্তব্যে তাঁর উদ্দেশ্য সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার সময় তিনি রুশ সাম্রাজ্যের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন।
ইউক্রেনের দিক থেকে রাশিয়ার মনগড়া হুমকি বিবেচনা করে পুতিন কিয়েভ অভিমুখে বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনা করছেন। পুতিনকে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে। ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিক থেকে এখন রাশিয়াকে বাগে আনার নীতি কী হবে? আরও বড় সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে রাশিয়া যাতে প্রকৃতপক্ষে শক্ত বাধা পায় এবং পুতিন যাতে তার এ ‘অভিযাত্রা’ থেকে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হন, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। পুতিন এবং তাঁকে ঘিরে থাকা অনুচর এবং যারাই ইউক্রেন যুদ্ধকে সমর্থন করেছে, তাদের ওপরেই নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। কিন্তু ত্বরিত ব্যবস্থা হিসেবে প্রকৃতপক্ষেই সেনা মোতায়েন করতে হবে। ইউক্রেনের সংঘাত নিরসনে চীনকে এ প্রক্রিয়ায় যতটা সম্ভব যুক্ত করে নিতে হবে। চীন ও পশ্চিমাদের মধ্যকার সম্পর্ক এ মুহূর্তে তেমন উষ্ণ নয়। কিন্তু দুই পক্ষই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। গত এক দশকে বেল্ট অ্যান্ড রোডস মহা প্রকল্পের আওতায় চীন ওই অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে।
ইউরোপের নতুন একটি নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে রাশিয়ার যে দাবি, তাতে সমর্থন দিয়ে আসছে চীন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব এবং সীমানাগত অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করে চীন। পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর চীন রাশিয়াকে বড় মাত্রায় অর্থনৈতিক সমর্থন দেবে, এমন মনে করা ঠিক হবে না। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরামে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে তারা রাশিয়াকে অন্ধভাবে সমর্থন জানাবে, সেটাও ঠিক নয়। তবে এটাও মনে করা ঠিক হবে না, রাশিয়ার বিপক্ষে পশ্চিমাদের পক্ষে খোলাখুলি অবস্থান নেবে চীন। ইউক্রেনে নিজেদের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রক্ষা করার জন্য রাশিয়াকে নিজেদের স্বার্থেই কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে চীন।
পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর চীন রাশিয়াকে বড় মাত্রায় অর্থনৈতিক সমর্থন দেবে, এমন মনে করা ঠিক হবে না। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরামে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে তারা রাশিয়াকে অন্ধভাবে সমর্থন জানাবে, সেটাও ঠিক নয়। তবে এটাও মনে করা ঠিক হবে না, রাশিয়ার বিপক্ষে পশ্চিমাদের পক্ষে খোলাখুলি অবস্থান নেবে চীন। ইউক্রেনে নিজেদের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রক্ষা করার জন্য রাশিয়াকে নিজেদের স্বার্থেই কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে চীন।
নিরাপত্তা প্রথমে
সবকিছু ছাপিয়ে যদি বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃস্থাপনের জন্য কূটনীতির উপযোগী একটি বিষয় হয়, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী? প্রথমত, রাশিয়া এ ক্ষেত্রে আলোচনার কোন পদ্ধতি বেছে নেবে, সেটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংকটের যে জটিলতা, তাতে সবার আগে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। এরপর রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের আরও বড় পরিসরে আলোচনা হতে হবে।
ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ফলে যে মানবিক বিপর্যয় সেখানে উদ্ভব হচ্ছে, সেটা মোকাবিলার পথ খুঁজে বের করতে হবে। কেননা, সংকটের যে গুরুত্ব ও পরিধি সেটা ইউক্রেনের থেকেও বহুদূর ছড়িয়ে পড়ছে। তবে এ ধরনের আলোচনা স্বল্প মেয়াদে সম্ভব নয়। তবে বর্তমান সংঘাত থেকে উত্তরণের জন্য এ কূটনৈতিক কৌশলকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে।
বিশ্বশান্তি ফেরানোই মূল চ্যালেঞ্জ
ইউক্রেনের জন্য এ মুহূর্তের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধ হওয়া এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাদের দেশের সীমান্তে শান্তি ফিরিয়ে আনা। পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হচ্ছে, রাশিয়ার আগ্রাসন থামানো এবং পশ্চিমা জোটকে (ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) ঐক্যবদ্ধ রাখা। এ মুহূর্তে উদ্দেশ্যসাধনের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ মেয়াদে ইউরোপের জন্য একটা কার্যকর নিরাপত্তাব্যবস্থা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের যৌথ সীমান্ত-নিরাপত্তা সম্পর্ক তৈরি হবে। ইউরেশিয়ান পরিধির মধ্যে এটা পুতিনকে তাঁর প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ করে দেবে। পুতিন এ ক্ষেত্রে পশ্চিম ও চীনের মধ্যে একটা সেতুবন্ধের কাজ করতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া নতুন ত্রিমেরু বিশ্বে একটা খুঁটি হয়ে উঠতে পারবে। আমেরিকার জো বাইডেন, চীনের সি চিন পিং ও রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, এই ‘তিন বড় নেতা’ ইউক্রেন সংঘাত নিরসনের পরবর্তী কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রধান ভূমিকা পালনকারী হতে পারেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ অন্য নেতারাও এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্টেফান উলফ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক অধ্যাপক