অ্যালোনা নামের মেয়েটা ছয় বছরেই এমন সব ছবি আঁকছে যে স্কুলে রীতিমতো সাড়া পড়ে গেছে। ড্রয়িংয়ের হাত ভালো। এর চেয়েও ভালো তার কল্পনা। সে সবকিছুরই ডানা দেয়। মানুষের ডানা আছে। তারা উড়তে পারে। গাছেরও ডানা আছে। সাইকেলের ডানা আছে। গাড়ির ডানা আছে। বিড়ালের ডানা আছে। এমনকি ডানা আছে মাছেরও।
আর অ্যালোনার আঁকা মানুষের চুলের রং হয় সবুজ। তার শিক্ষক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার মানুষের চুলের রং সবুজ কেন?
অ্যালোনা জবাব দিয়েছে, গাছের পাতার রং সবুজ যে তাই। চুলে ক্লোরোফিল আছে। সূর্যের আলো থেকে ফটোসিনথেসিস করে চুল খাবার বানায়।
অ্যালোনার মা নিনা। তিনি একজন ইউক্রেনীয়। আর অ্যালোনার বাবা জর্জি। জর্জি অ্যানিমেশন ফিল্মের জন্য ছবি আঁকেন। নিনা আর জর্জি মস্কোতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়তেন। বিয়ে হয়েছে ১০ বছর আগে। এখন নিনা থাকেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে। নিনার মায়ের ক্যানসার। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, নিনার মা আর বেশি দিন বাঁচবেন না। শেষ দিনগুলো মাকে সময় দেওয়ার জন্য নিনা কিয়েভে আছেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে অ্যালোনাকে ভর্তি করে দিয়েছেন এখানকার এক স্কুলে। কোভিডের মধ্যে কখনো হোম স্কুল, কখনো সশরীর স্কুল হচ্ছে। অ্যালোনার জন্ম হয়েছিল মস্কোতে। মস্কোর প্রি–স্কুলে সে কিছুদিন পড়েওছে। ফলে মস্কোর আঞ্চলিক টানের রুশ ভাষাটাই সে শিখেছিল আগে।
এখন কিয়েভের স্কুলে গিয়ে ইউক্রেনীয় ভালো করেই শিখে ফেলেছে। দুটোই ভাষাই সে বলতে পারে। মায়ের স্মার্টফোনটা নিয়ে সে রুশ অ্যানিমেশন দেখে। কারণ, বাবা অ্যানিমেশন ছবি বানান। আবার টেলিভিশনে ইউক্রেনে বানানো কার্টুন ছবি দেখতেও অ্যালোনা ছাড়ে না। অ্যালোনা বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে ভিডিও-আলাপ করে। বাবা, ভাগ্যিস তুমি ইউক্রেনে থাকো না। তুমি তো একজন রাশান। তাই তোমাকে যুদ্ধে যেতে হচ্ছে না। আমার ইলিচ মামাকে যুদ্ধে যেতে হবে। সরকার নির্দেশ দিয়েছে। সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে।
জর্জি বলেন, হ্যাঁ। আমার ভাগ্য ভালো যে আমি ইউক্রেনীয় নই। তাহলে আমাকে ছবি আঁকা বাদ দিয়ে যুদ্ধ করতে যেতে হতো। যেমন তোমার মামাকে করতে হচ্ছে।
অ্যালোনা বলে, তখন তুমি তুলি আর পেনসিলের বদলে বন্দুক হাতে নিতে। আর লাল রঙের গোলাপ আঁকার জন্য রঙের বদলে আমার মামা ইলিচের রক্ত তোমাকে ব্যবহার করতে হতো।
পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অ্যালোনার মা নিনা। তিনি কেঁদে ওঠেনপ্রায়, অ্যালোনা, তুমি এসব কী বলছ!
নিনা মেয়ের হাত থেকে ফোন নেন। নিনা বলেন, অ্যালোনা কী বলছে শুনলে! ও ছবিও আঁকে অদ্ভুত। সবুজ রঙের চুল। ডানাওয়ালা গাড়ি।
জর্জি হাসেন। আমার মেয়ে তো। ও তো প্রডিজি হবেই। তারপর হাসি থামিয়ে বলেন, তোমরা মস্কো চলে এসো।
নিনা বলেন, কেমন করে আসব বলো তো। মায়ের অবস্থা তো শেষের দিকে। যেকোনো দিন তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন। রোজ দুবেলা তাঁকে দেখতে নার্সিং সেন্টারে যাই। তিনি আমার হাত ধরে বসে থাকেন। বলেন, তোর হাতটা ধরলে যেন স্বর্গের সুখ পাই।
অ্যালোনা বলে, বাবা, তোমরা আমার মামাবাড়ির ওপরে বোমা ফেলছ কেন?
জর্জি বলেন, মা রে, সেটা তো আমার মতো আর্টিস্ট বলতে পারবে না। শোনো, টুইটারে একটা কবিতা দেখছি। মাহমুদ দারবিশ নামের এক কবির লেখা:
‘যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে।
নেতারা হাত মেলাবে।
বৃদ্ধা তাঁর শহীদ সন্তানের ফিরে আসার জন্য পথ চেয়ে অপেক্ষা করতেই থাকবেন।
মেয়েটি অপেক্ষা করবে তার প্রিয়তম স্বামীর জন্য।
আর তাঁর সন্তানেরা অপেক্ষা করবে তাদের বীর বাবার জন্য।
আমি জানি না, কে আমাদের জন্মভূমিটাকে বেচে দিয়েছিল,
কিন্তু আমি দেখেছি, তার দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে কাকে।’
অ্যালোনা বলে, বাবা, আমি তোমার কথা কিছু বুঝছি না।
নিনার চোখ জলে ভিজে আসে।
ঠিক সে সময় সাইরেন ওঠে বেজে।
নিনা বলে, ফোন রাখি। আমাদের এখন বেসমেন্টে দৌড়াতে হবে।
১৩ তলা থেকে বেসমেন্টে দৌড়ে নামা সহজ নয়। এক হাতে অ্যালোনাকে ধরে নিনা সিঁড়ি বাইতে থাকেন। ঠিক তখনই একটা গোলা এসে সিঁড়ির পাশের জানালায় আঘাত হানে।
পুরোটা সিঁড়িঘর ধোঁয়ায়-ধুলায়-বারুদে-আগুনে আচ্ছন্ন অগম্য শ্বাসরোধী হয়ে ওঠে।
অ্যালোনা বলে, মা, আমাদের ডানা আছে। মা, চলো আমরা উড়ি। বোমার আঘাতে দেয়ালের ফুটো দিয়ে বাইরের আকাশ দেখা যাচ্ছে, মা। মা, আমরা এই ১০ তলা থেকে উড়ে নিরাপদে চলে যেতে পারব।
নিনা তখন কাশি দিচ্ছেন। তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে উঠছে...
তিনি মেয়েকে বুকের মধ্যে নেন। মাথার ওপরে ইট-কাঠ-পাথর এসে পড়ছে। আগুনের হলকা উঠেছে কোথাও।
অ্যালোনা বলে, মা, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি মারা যাচ্ছি। মা, আমাকে তুমি ওই ফাঁকাটার কাছে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দাও। আমি উড়তে পারব।
নিনার শরীর এলিয়ে পড়ে। তিনি জ্ঞান হারান। তাঁদের মাড়িয়ে কতগুলো মানুষ সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে ছুটতে থাকে। বাইরে প্রচণ্ড গর্জন।
অ্যালোনা মাকে টানতে টানতে সিঁড়ির দেয়ালের ফোকরের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তার শ্বাসও বন্ধ হয়ে আসছে।
অ্যালোনা তার ডানা দুটো মেলে ধরে। সে এখন আকাশে উড়ছে...
আকাশে...নীল আকাশে...দুদিন পরে আন্তর্জাতিক একটা নিউজ এজেন্সি সারা পৃথিবীতে ছবি ছাপিয়ে দেয়: কিয়েভের একটা আবাসিক বহুতল ভবনের সিঁড়িতে মায়ের কোলে মেয়ে...নিসাড় শুয়ে আছে...মেয়েটার চোখ খোলা...তার চুলের রং সবুজ...
(বানিয়ে লিখলাম গল্পটা। নামগুলোর একটা-দুটো নিলাম নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন থেকে: ‘মাই কাজিনস আর কিলিং ওয়ান অ্যানাদার। ওয়ার ইন ইউক্রেন স্প্লিট মিক্সড ফ্যামিলিজ’।) ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ৩ মার্চ ২০২২ জানাচ্ছে, রাশিয়া সরকারিভাবে বলছে, তাদের ৪৯৮ জন সৈন্য মারা গেছে। ১ হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছে। ২ হাজার ৮০০ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য মারা গেছে। আর ইউক্রেন বলছে, এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৮০০ রুশ সৈন্য মারা গেছে। এর মধ্যে বেসামরিক মানুষের হতাহত হওয়ার খবর কেউ বলেনি। আমরা বলব, মানুষ সামরিক না বেসামরিক, তারও চেয়ে বড় কথা মানুষটি মানুষ। মানুষ তো সংখ্যা নয়। বাংলাদেশের নৌপ্রকৌশলী হাদিসুর রহমান ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে সমৃদ্ধি নামের জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মারা গেছেন। বরগুনায় তাঁর বাড়িতে কান্নার রোল।
মানুষ কর্তৃক মানুষ হত্যা এই পৃথিবীতে কোনো দিনও বন্ধ হবে কি? মানুষ মানুষকে বাঁচাতে পারে না, ভাইরাসের সঙ্গে পারে না, কিন্তু পৃথিবীটাকে ছয়বার ধ্বংস করার অস্ত্র তারা বানিয়ে রেখেছে। ২০২২-এ মানুষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর বাস্কেট বলের স্কোরবোর্ড দেখার মতো উল্লসিত হয়।
মানুষ, কবে তুমি মানুষ হবে!
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক