যুদ্ধের প্রথম বলি ‘সত্য’
যেকোনো যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বলির নাম ‘সত্য’। যুদ্ধতথ্য মুড়িমুড়কি-খইয়ের মতোই ফুটতে থাকে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধবিষয়ক তথ্যেরও নির্বিচার প্রচার ও ছড়াছড়ি বাড়বে। সত্য কিংবা মিথ্যা হোক, যুধ্যমান দুই পক্ষই নিজ নিজ কৃতিত্বের ও সাফল্যের বানোয়াট দাবি করেই চলবে। এ জন্য সব তথ্য ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অন্ধভাবে বিশ্বাস করার বিপদ আছে। দুই বিবদমান পক্ষের বাইরে সাংবাদিকদের জানানো তথ্যেও নির্বিচার নির্ভরতার সুযোগ নেই। টুইটারে-ফেসবুকে উপচে পড়ছে নানা রকম শেয়ার হওয়া তথ্য। যেমন ফ্রান্স ও পোল্যান্ড থেকে অস্ত্রসম্ভার ইউক্রেনে পৌঁছে গেছে। ফ্রান্স, পোল্যান্ড খবরের সত্যতা সুনিশ্চিত করেনি। ইউক্রেনের তুরস্ক দূতাবাস নাকি জানিয়েছে, তুরস্কের ড্রোন হামলায় কয়েক শ রাশিয়ান সেনার একটি বহর ছাই হয়ে গেছে। রাশিয়ার বসফরাস প্রণালি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তুরস্কের রাষ্ট্রপক্ষ অবশ্য তথ্যগুলো নিশ্চিত করেনি। রাশিয়ার ব্যবহৃত জেফ বেজোসের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়াসহ সব মহল থেকে রাশিয়ার প্রতি সর্বাত্মক অবরোধ ঘোষণার তথ্যও এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি।
সাইবার যুদ্ধকৌশল হবে এ যুদ্ধের বিশেষ নিয়ন্তা
এ যুদ্ধ আগের যুদ্ধগুলোর মতো হওয়ার সম্ভাবনা কম। তথ্যযুদ্ধও আধুনিক যুদ্ধের একটি কৌশল। অনলাইন-অফলাইন তথ্যজগৎ, ফেসবুক-টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে তীব্র রাশিয়াবিরোধী প্রচার-প্রচারণাকে একটি কার্যকর যুদ্ধকৌশল হিসেবে দেখা দরকার। লক্ষণীয়, পশ্চিমে সামাজিক মাধ্যমে এ যুদ্ধ যতটা আলোচিত-আলোড়িত হচ্ছে, আগের সংঘাতগুলোতে কখনোই তেমনটি দেখা যায়নি। তথ্যের চমক ও শেয়ারের জোয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথেষ্ট সংক্রামক হয়। লক্ষণীয়, পশ্চিমের রাজনীতিকেরা যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এড়িয়ে চলতেন, তাঁরাও হঠাৎ টুইটারে সরব। তাতে ইউক্রেনীয় স্বদেশবাদীদের মনোবল আকাশ ছুঁয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ান বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ছে। এখনো পর্যন্ত ইউক্রেনের বড় শক্তি বিশ্ববাসীর নৈতিক সমর্থন। আম-ইউক্রেনবাসী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববাদের নৈতিক শক্তিতে একাত্ম হচ্ছেন। অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন। নারীরা ঘরে ঘরে মলোটভ ককটেল বানানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সরকার ১৮ হাজার সমরাস্ত্র সাধারণ্যে বিলি করেছে। অন্যদেরও প্রতিরোধযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে। জেলেনস্কির দেশ না ছাড়ার এবং শেষ শক্তিটুকু নিয়েও লড়ে যাওয়ার ঘোষণা আমজনতাকে উদ্দীপ্ত করে তুলছে নিশ্চিত।
এ যুদ্ধ অঞ্চলের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাবে। যেসব ইউক্রেনীয় প্রবাসে আছেন, যাঁদের ডায়াস্পরা কমিউনিটি বলা হয়, তাঁরা এককাট্টা হচ্ছেন। অন্য রকম যুদ্ধে নামতে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে অনেক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আছেন। আওয়াজ উঠেছে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব কৌশলগত স্থাপনায় সাইবার যুদ্ধ চালানোর। ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। শুরুটা করেছিল রাশিয়া ১৯১৩ সালে। হ্যাকিং কাজে ব্যবহৃত উরুবুরু নামের সাইবার অস্ত্র প্রয়োগ করে সে বছর রাশিয়া ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের কার্যক্রম বিকল করে দিয়েছিল। ঘটনাটি সে সময়ের রাশিয়াপন্থী প্রধানমন্ত্রী ইয়ানুকোভিচের পতনের পেছনে অন্যতম কারণ হয়ে ছিল। ২০১৪ সালে গণবিপ্লবের মুখে তাঁর পতনের পর ইউক্রেনও পাল্টা সাইবার অস্ত্র নির্মাণে মনোযোগ দেয়। সে সময় থেকেই ইউক্রেন ও রাশিয়ার শতাধিক পাল্টাপাল্টি সাইবার আক্রমণের ঘটনা ঘটে। রাশিয়াও ইউক্রেনকে সমঝে চলতে শুরু করে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি হ্যাকারদের সংঘ ‘অ্যানোনিমাস’ টুইটারে ঘোষণাই দিয়ে বসেছে যে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের হয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে। ‘হ্যাকটিভিজম’ বা ‘হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অ্যাকটিভিজমের’-এর দক্ষতার কারণে ‘অ্যানোনিমাস’কে ভয় না পাওয়া দেশ তেমন নেই। রাশিয়াকেও প্রমাদ গুনতে হচ্ছে নিশ্চিত।
নৈতিক স্খলন-অস্ত্র ব্যবহারও বাড়বে
যুদ্ধে সৈনিকদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাদের স্খলনের কারণ হয়। রাশিয়ার সেনারা যেমন ধরেই নিয়েছিল, ইউক্রেন দখলে কোনো সমস্যাই হবে না। তাই লুহানস্ক, দোনেৎস্ক ও কিয়েভে ঢোকামাত্রই তারা অনলাইন প্রেম-প্রণয়ের অ্যাপ টিন্ডারের মাধ্যমে নিজদের পৌরুষদীপ্ত দেহ দেখানো ছবিসহ ইউক্রেনীয় তরুণীদের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার আহ্বান জানাতে লাগল। সুন্দরী ও আকর্ষণীয় হিসেবে পরিচিত ইউক্রেনীয় নারীদের পক্ষ থেকেও নাকি এই মুহূর্তে শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা প্রচুর আমন্ত্রণ যাচ্ছে রাশিয়ান সেনাদের কাছে। ‘হানি-ট্র্যাপ’ বা যৌনফাঁদ যুদ্ধের পুরোনো কৌশল। সম্ভবত ইউক্রেনীয় নারীরা হানি-ট্র্যাপ কৌশল যুদ্ধে নামতেও দ্বিধান্বিত হচ্ছেন না। যখনই রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছে, এ যুদ্ধে সহজেই জিতে যাওয়া বা দখলের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম, যুদ্ধের প্রয়োজনে স্যাটেলাইট ও জিপিএসের ব্যবহারটুকু রেখে অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত ইন্টারনেট ব্যবহার একেবারেই সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। কথায় আছে, যুদ্ধ ও প্রেমে সবই সিদ্ধ, সবই নৈতিক। এ যুদ্ধে এ ধরনের নৈতিকতার প্রয়োগ ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। শুধুই অস্ত্রনির্ভর যুদ্ধকৌশল-সংক্রান্ত ভাবনা দিয়ে এ যুদ্ধের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতি বোঝা যাবে না।
সব পক্ষই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চায়
একটি বিষয় অনেকেই বলাবলি করছেন যে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ইউক্রেনকে গাছে তুলে মই সরিয়ে নিয়েছে। জেলেনস্কি নিজেও বলেছেন, তিনি একা হয়ে পড়েছেন এবং সব আন্তর্জাতিক মহলই সহায়তা-সহানুভূতির কথাই বলে চলেছে, সশস্ত্র সহায়তায় এগিয়ে আসছে না। রাশিয়ান আগ্রাসনের আগে আগেই কৃষ্ণসাগর থেকে ন্যাটোর সামরিক মহড়াবহর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, এমন খবরও মিলেছে। ২৬টি দেশ ইউক্রেনকে যুদ্ধে সহায়তা দেবে জানালেও ‘প্রয়োজনে’ শব্দটি বলতে ভোলেনি। ‘প্রয়োজনে’ সহায়তা মানে শর্ত সাপেক্ষে। কৌশলগত আঞ্চলিক অবস্থানের তুরস্ক একটি দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন খরচের বেলায়ও সাবধানতা দেখাচ্ছে। ভারত, চীন, আমিরাত জাতিসংঘে রাশিয়ার বিপক্ষে ব্যবস্থাসহ প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকল। আসলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো কোনো পরিস্থিতি যেন ভুলেভালেও তৈরি না হয়ে পড়ে, সেদিকেই সব পক্ষ সতর্ক ও সাবধানী বিবেচনার বিষয়টি মাথায় রেখে কর্মপন্থা নির্ধারণ করছে। কৌশল একটিই। রাশিয়াকে চূড়ান্ত মানসিক চাপে রাখা। ভোটদানে বিরত থাকা মানে সমর্থন-অসমর্থন কোনোটিই নয়। এটিও রাশিয়ার জন্য ভয়াবহ মানসিক চাপ। সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের দিকেই বিশ্বশক্তির নজর। পুতিনকে একঘরে ও দিশেহারা করে তোলাই আপাতত সেরা কৌশল। এ যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে গড়ানোর কোনো কারণই আপাতত বর্তমানে নেই।
রাশিয়ার বিশ্বায়ন, ভোক্তাবাদ ও নব্য রাশিয়ান প্রজন্মের অসমর্থন
গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকার খোলা হাওয়ার প্রভাবে নব্বইয়ে শুধু সমাজতন্ত্রেরই বিপর্যয় ঘটেনি, বরং পশ্চিমা খাবারদাবার, পোশাক-আশাক, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রুচি—সবই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে আগের সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। আটটি দশক সম্পূর্ণ নিজস্ব উৎপাদিত পণ্যের স্থান দখল করে নেয় পশ্চিমা পণ্য। পশ্চিমা বিনিয়োগও হয়েছে অভাবনীয় মাত্রায়। বহুজাতিকদের অনেক সংস্থা বিনিয়োগ ও ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নতুন প্রজন্ম নেশাসক্তের মতো ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং, কেএফসিসহ পশ্চিমা খাদ্যের ভোক্তারূপে বেড়ে উঠছে। পোলো, র্যাংলার, অ্যাডিডাস, নাইকি, লিভাইস ইত্যাদি এখন তরুণ সমাজের নিত্যব্যবহার্য পোশাক। পশ্চিমা সংগীতেরও একটি বড় বাজার হয়ে পড়েছে রাশিয়া। নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বপুরুষদের পার করা অতীত আটটি দশকে সোভিয়েতের ‘একলা চলো’ নীতি দেখেনি। স্থানীয় উৎপাদিত দ্রব্যে সন্তুষ্ট থাকতে শেখেনি। তাদের সাংস্কৃতিক রুচি ও বিশ্বদৃষ্টি আগের প্রজন্মের চাইতে আলাদা। তার প্রমাণ আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে। পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের প্রাক্কালে নতুন প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত সমর্থন জুগিয়েছিল। দুদিন যেতে না যেতেই তাদের মতামত উল্টোমুখী। তারা পুতিনের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। বড় একাংশ কোনো যুদ্ধও চাইছে না।
অর্থাৎ ঘরে-বাইরে পুতিনের ওপর চাপ ও অসমর্থন এমনভাবে বাড়ছে যে তাঁকে একটি একক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে যেতে হবে দীর্ঘদিন। যুদ্ধটির অপ্রচলিত ও আগে না দেখা রূপ একটি নতুন সমর সমাজবিদ্যা এবং নিত্যনতুন সমাজভাবনার জন্ম দেবে।
● হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়