প্রিয় পাঠক, জুডিথ মিলারকে মনে পড়ে কি? চলতি শতকের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে নিউইয়র্ক টাইমসে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাদ্দাম হোসেনের বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত গড়ে নেওয়া সম্পর্কে ‘বিশ্বস্ত সূত্রে’ পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করে বিশ্বকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য রাখা সেই ‘অভূতপূর্ব অবদানের’ প্রতিদান হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকতা জগতের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি পুলিৎজার পুরস্কার। তার সেই সব ধারাবাহিক প্রতিবেদনকে সত্য হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র এরপর নেমেছিল ইরাক যুদ্ধে। আমরা জানি, সেই যুদ্ধের পরিণাম কী হয়েছিল।
যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আর পশ্চিমা বিশ্বের একতরফা বিজয়ের পরপরই প্রকাশ হয়ে যায় যে জুডিথ মিলারের সেই অভিযোগের পেছনে সত্যের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া ছিল না। শুধু তা–ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সেইমুর হার্শের কল্যাণে বিশ্ব আরও জেনে যায় যে জুডিথ মিলারকে সেই সব বানোয়াট প্রতিবেদন লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল স্বয়ং সিআইএ। এসব অভিযোগ যেন যুক্তিসংগতভাবে উপস্থাপন করা যায়, তা নিশ্চিত করে নিতে নানা রকম জাল দলিলপত্রও গোয়েন্দা সংস্থাটি তাদের পছন্দের সেই সাংবাদিককে নিয়মিত সরবরাহ করে গেছে। সত্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর জুডিথ মিলার অবশ্য সংবাদের জগৎ থেকে একেবারেই হারিয়ে যান। নিউইয়র্ক টাইমস পরে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে পাঠকদের বিভ্রান্ত করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।
আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমকে ‘দেবতা’ হিসেবে মেনে নিয়ে, যা লিখছে কিংবা প্রচার করছে, ভিন্ন অবস্থান থেকে এ নিয়ে কোন খোঁজখবর না রেখে নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করছি, জুডিথ মিলারের কাহিনি তাদের জন্য জুতসই এক তুলনামূলক দৃষ্টান্ত বিবেচিত হতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমসের সাবেক সেই প্রতিবেদকের সেদিনের হঠকারী অবস্থানের কল্যাণে এ–পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন দুই লাখের বেশি মানব সন্তান। তাই এই দৃষ্টান্ত আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে যে সাংবাদিক কিংবা সংবাদ প্রতিবেদক বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ না থাকলে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
ইদানীং বাংলাদেশের এক শ্রেণির সংবাদপত্র যুদ্ধের ধুয়া তুলে রাশিয়াকে তুলাধুনা করে চলেছে। সেসব লেখা পড়ে জুডিথ মিলারের সাংবাদিকতার বিষয়টি আমার আবারও মনে পড়ে গেল। ইউক্রেনকে ঘিরে ইউরোপে এখন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজছে। পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম যুদ্ধ শুরু হওয়া নিয়ে বিরতিহীন আওয়াজ তুলে যাওয়ার কল্যাণে অনেকেই ধরে নিয়েছেন, এই যুদ্ধপ্রস্তুতির পেছনে আছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্রাজ্যের লোভ। এমনও বলা হচ্ছে যে ইউক্রেনের মানুষের পরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এ রকম সব অভিযোগের পেছনে যারা বাতাস দিয়ে চলেছে, মার্কিন সরকারের বাইরে তারা হচ্ছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম, যার মালিকানা পুরোটাই বিশাল পুঁজির খপ্পরে। এই পুঁজির বড় এক স্বার্থ জড়িত আছে অস্ত্র ব্যবসায়। যুদ্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান যে হয় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা, সেই সত্য তো আমাদের অজানা নয়। আর তাই যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে ওঠার সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসার সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করা হলে সত্যের অপলাপ তাতে একেবারেই হয় না।
জুডিথ মিলারকে মনে পড়ে কি? চলতি শতকের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে নিউইয়র্ক টাইমসে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাদ্দাম হোসেনের বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত গড়ে নেওয়া সম্পর্কে ‘বিশ্বস্ত সূত্রে’ পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করে বিশ্বকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য রাখা সেই ‘অভূতপূর্ব অবদানের’ প্রতিদান হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকতা জগতের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি পুলিৎজার পুরস্কার। তার সেই সব ধারাবাহিক প্রতিবেদনকে সত্য হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র এরপর নেমেছিল ইরাক যুদ্ধে। আমরা জানি, সেই যুদ্ধের পরিণাম কী হয়েছিল।
কেউ হয়তো এ রকম যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে ইউক্রেন তো পাচ্ছে সব বিনা পয়সার অস্ত্র, ফলে লাভ-ক্ষতির হিসাব–নিকাশ এখানে কেন? হ্যাঁ, সেই হিসাব অবশ্যই আছে। ইউক্রেনকে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের সরকার বিনা মূল্যে অস্ত্র সরবরাহ করে গেলেও সরকারকে কিন্তু তা কিনে নিতে হচ্ছে দেশের ভেতরের অস্ত্র উৎপাদকদের কাছ থেকে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কোনো একটি দেশের সরকার কিংবা ন্যাটো জোটকে বিনা মূল্যে অস্ত্র কখনো সরবরাহ করে না। মূল্য এরা আদায় করে নেয় জনগণের করের অর্থে গড়ে ওঠা সরকারি তহবিল থেকে এবং সরকার কিংবা বিশেষ কোনো জোট, সেই সব অস্ত্র বিনা মূল্যে সরবরাহ করে অন্য কোনো দেশের তাঁবেদার সরকার কিংবা সামরিক বাহিনীর কাছে নিজেদের স্বার্থ ধরে রাখার উদ্দেশ্যে। তাই যুদ্ধের ডঙ্কার আওয়াজ আমরা পেলেও বাইরের এই হিসাব ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। আসুন, সেই হিসাব–নিকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে এবার একটু নজর দেওয়া যাক ইউক্রেন নামের দেশটির দিকে। কেননা, সেই দেশটিকে নিয়ে চলমান বিভিন্ন আলোচনাতেও জুডিথ মিলারদের মতো সাংবাদিকের প্রভাব, এমনকি আমাদের দেশের ‘বিশেষজ্ঞদের’ লেখাতেও খোলামেলাভাবেই ফুটে উঠছে।
জাতিরাষ্ট্রের যে ধারণা থেকে ইউরোপে রাষ্ট্রের বিকাশ, ইউক্রেনের বর্তমান কাঠামো, ঠিক সেই অর্থে জাতিরাষ্ট্রের সংজ্ঞায় পড়ে না (যেমনটা পরে সাবেক তিনটি বাল্টিক প্রজাতন্ত্র অথবা ককেশাস অঞ্চলের জর্জিয়া, আজারবাইজান কিংবা আর্মেনিয়া)। ১৯২৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের বড় একটি অংশ ছিল পোল্যান্ডের অধীন। ওয়ারশর এ অংশের দখলদারি নিয়েছিল ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে আস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের পতন হওয়ার পর। এর আগে, শতবর্ষের বেশি সময় ধরে সেই অঞ্চল ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরির হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের অধীন। পরিচিত ছিল বুকোভিনা নামে। বুকোভিনায় ইউক্রেনীয় জাতিসত্তার লোকজনের পাশাপাশি আরও ছিল ইহুদি, জার্মান, পোলিশ ও রুশদের বসবাস। জার্মান ভাষার ইহুদি বংশোদ্ভূত বিখ্যাত কবি পল সেলান ছিলেন বুকোভিনার মানুষ। বেঁচে থাকা অবস্থায় যিনি একাধিকবার নিজের রাষ্ট্রীয় পরিচয় পাল্টে যেতে দেখেছেন।
অঞ্চলটি সোভিয়েত আওতাধীনে আসে ১৯৩৯ সালে হিটলারের পোল্যান্ড দখলের পর, মস্কোর নেতৃত্বের সঙ্গে নাৎসি জার্মানির পরোক্ষ এক দেনদরবারের ভিত্তিতে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের অনেক এলাকার মানচিত্র নতুনভাবে নির্ধারিত হলে পশ্চিম ইউক্রেন স্থায়ীভাবে যুক্ত হয় সোভিয়েত ইউক্রেনের অংশ হিসেবে। এরপরও থেকে যায় ভাষা, ধর্ম ও আদর্শভিত্তিক ব্যবধান। এ ছাড়া ইউক্রেনের যে সনাতন ভূখণ্ড, সেখানেও রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার বিভাজন ছিল অনেক ক্ষেত্রেই অস্পষ্ট। দেশটির পূর্ব ও দক্ষিণের বড় একটি অংশজুড়ে ছিল রুশদের বসবাস, যেটা এখনো হচ্ছে সেই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। যে নিকোলাই গোগলকে নিয়ে টানাহেঁচড়ার দৃষ্টান্ত অনেকে তুলে ধরতে পছন্দ করেন, সেই গোগলের শহর পলতাভায় ছিল রুশ প্রাধান্য। গোগল ছিলেন জাতিগত দিক থেকে রুশ, পরবর্তী সময় যিনি নিবাস গড়েছিলেন রাশিয়ার সেই সময়ের রাজধানী সাঙ্কত পিওতরবুর্গে। এ ছাড়া রুশ ভাষাতেই তিনি লিখে গেছেন সব রচনা এবং চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন মস্কোতে।
অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে পলতাভার যুদ্ধে জার পিটারের বাহিনী সুইডেনের ভাইকিংদের পরাজিত করে প্রথমবারের মতো দৃঢ় ভিত্তির ওপর রুশ সাম্রাজ্যকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ফলে পলতাভার সঙ্গে আছে রুশদের আত্মিক সম্পর্ক। যদিও এখনকার রাশিয়া সেই অতীত ইতিহাসের আলোকে পলতাভার মালিকানা দাবি করছে না।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন থেকে বের হয়ে আসা নতুন রাষ্ট্রের অনেকগুলোতেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি রুশদের বসবাসের বৈশিষ্ট্য চোখে পড়লেও ইউক্রেনে সেটা ছিল অনেক বেশি স্পষ্ট। যে কারণে সেখানকার রুশভাষীদের স্বার্থরক্ষা নিয়ে রাশিয়াকে তখন থেকেই ভাবতে হয়েছে। পরবর্তী সময় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে জাতীয়তাবাদীদের প্ররোচনায় জাতিগত বিভাজন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠলে দেশটি কার্যত একই কাঠামোর ভেতরে ভিন্ন দুটি অস্তিত্ব নিয়ে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন থেকে বের হয়ে আসা নতুন রাষ্ট্রের অনেকগুলোতেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি রুশদের বসবাসের বৈশিষ্ট্য চোখে পড়লেও ইউক্রেনে সেটা ছিল অনেক বেশি স্পষ্ট। যে কারণে সেখানকার রুশভাষীদের স্বার্থরক্ষা নিয়ে রাশিয়াকে তখন থেকেই ভাবতে হয়েছে। পরবর্তী সময় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে জাতীয়তাবাদীদের প্ররোচনায় জাতিগত বিভাজন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠলে দেশটি কার্যত একই কাঠামোর ভেতরে ভিন্ন দুটি অস্তিত্ব নিয়ে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। রাশিয়ার সেই উদ্বেগ এ ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই আরও কিছুটা বাড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতা–পরবর্তী ইউক্রেনের সব কয়টি নির্বাচনে এই জাতিগত বিভাজন মূলত মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ইউক্রেনের যোগদানের প্রস্তুতিকে ঘিরে চলতে থাকা বিতর্ক শেষ পর্যন্ত দুই শিবিরের বিভাজন আরও সম্প্রসারিত করে দেয়। জাতীয়তাবাদীরা ইইউ-তে দেশের যোগদানকে দেখেছিল রাশিয়ার প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসার চমৎকার সুযোগ হিসেবে। অন্যদিকে রুশপন্থীরা ভেবে নিয়েছিল যে রাশিয়ার সঙ্গে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের পাঁয়তারা হচ্ছে দেশটির পশ্চিমের বলয়ে ভিড়ে যাওয়া। এ কারণে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে আলোচনা স্থগিত করে দিলে জনতা পথে নেমে আসে এবং ইয়ানুকোভিচের সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে।
অন্যদিকে আবার ইয়ানুকোভিচের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে জাতীয়তাবাদীরা এককাট্টা হয়ে মাইদান আন্দোলন শুরু করলে পশ্চিমের জন্য সেটা ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চমৎকার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। মাইদান আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের পরোক্ষ সমর্থন পেয়ে শুরু হওয়া বর্ণ বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়।
ইউক্রেনের বর্তমান সংকটের সূচনা এর থেকে। পরবর্তী সময় যেটা এতটাই উগ্র জাতীয়তাবাদের আকার নেয় যে ইউক্রেনের ক্ষমতাসীনেরা রুশ-বিরোধিতার ধুয়া তুলে ১৯৩০–এর দশকের শেষ দিক থেকে পশ্চিম ইউক্রেনজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা স্থানীয় নাৎসি নেতা স্তেফান বান্দেরার বন্দনাই কেবল গাইতে শুরু করেননি, সামরিক বাহিনীতে বান্দেরার নামের একটি ব্রিগেডও তারা গড়ে তুলেছেন। হিটলারের জার্মানির সহায়তা নিয়ে বান্দেরা এবং তার অনুগতরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ইহুদি, রুশ এবং পোলিশদের ওপর যে ব্যাপক নিপীড়ন সেই সময় চালিয়েছিল, সেটাকে আজও গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাই সেরকম এক গণহত্যার নায়ককে বীরের আসনে বসানো রাশিয়ার পাশাপাশি ইউরোপের অন্যান্য বেশ কিছু দেশও সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি।
মাইদান আন্দোলনের কারণে ইয়ানুকোভিচ সরকারের পতনকে রাশিয়ার পাশাপাশি ইউক্রেনের রুশরা দেখেছিল অশনিসংকেত হিসেবে। তাই কিয়েভের নতুন প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টির একটি হাতিয়ার হিসেবে রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে প্রশাসনিক আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টায় তারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। এর থেকে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। পরবর্তী সময় যেটা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে পূর্বাঞ্চলের রুশদের দানিয়েস্ক-লুহান্সক গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
তবে পৃথক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হলেও চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে যায় ইউক্রেনের সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতায় উপনীত হয়ে পূর্বাঞ্চলের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে নেওয়া। সেই লক্ষ্য অর্জনে রাশিয়ার পাশাপাশি ফ্রান্স ও জার্মানি সমঝোতা প্রচেষ্টায় যোগ দিলে ‘নরমান্ডি প্রক্রিয়া’ নামের পরিচিত আলোচনার সূত্রপাত সেখান থেকে হয়। এবং পরবর্তী সময় ইউরোপের শান্তি ও সহযোগিতা সংগঠন ওএসসিইর মধ্যস্থতায় চলা আরও কয়েক দফার আলোচনার শেষে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে রাশিয়া, ইউক্রেন, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতৃত্ব এবং ওএসসিই ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘মিনস্ক চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। ১৩ দফা সেই চুক্তিতে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে ইউক্রেনের সরকারের সঙ্গে দানিয়েতস্ক-লুহান্সক অন্তর্বর্তী প্রশাসনের আলোচনা শুরু করা এবং যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অঞ্চল থেকে সব রকম ভারী অস্ত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও গত সাত বছরে চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।
মিনস্ক চুক্তিকে এখনো সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পাওয়ার সবচেয়ে জুতসই একটি উপায় হিসেবে দেখা হলেও ইউক্রেন এখন বলছে, সেই চুক্তি দেশটির স্বার্থের অনুকূল নয়। এ রকম দাবি তুলে দেশের বর্তমান নেতৃত্ব এর কিছু ধারা রদবদল করে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তবে কথা হলো, ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেত্রো পেরশেঙ্কো চুক্তি স্বাক্ষর করায় বৈধতার দিক থেকে কোনো রকম সমস্যা এতে নেই। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন ইউক্রেন হঠাৎ করে মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নে নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করছে? ধারণা করা হয়, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন মদদ ইউক্রেনের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে চলেছে। মার্কিন প্রশাসন কিন্তু মিনস্ক চুক্তি নিয়ে একেবারেই নীরব। পাশাপাশি প্রশাসনের এই নীরবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমও মিনস্ক চুক্তি নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করছে না, যেমনটা এরা করছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার কাল্পনিক দিন তারিখ ঠিক করে নিয়ে ভয়াবহ এক বিপদ নেমে আসার আশঙ্কা নিয়ে।
সম্ভবত এসব হিসাব–নিকাশের আলোকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিছুদিন আগে মস্কোতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা আলোচনার শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই মিনস্ক চুক্তির পরোক্ষ উদ্ধৃতি টেনে ইউক্রেনকে উদ্দেশ করে ‘মাইয়া ক্রাসাভিতসা’ বা ‘সুন্দরী আমার’ উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘তুমি চাও কিংবা না–চাও, বাস্তব হচ্ছে, একে নিয়ে তোমার থাকতে হবে।’ পরে অন্য এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টির আরও বিস্তৃত যে ব্যাখ্যা তিনি দেন, তার মর্মার্থ ছিল এ রকম—চুক্তিতে দেশের প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর থেকে যাওয়ায় চুক্তি মেনে চলা হচ্ছে স্বাক্ষরকারী যেকোনো দেশের নৈতিক দায়িত্ব এবং সেই দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করা হলে দেশের উচিত হবে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়া। ইউক্রেন অবশ্য অন্তত চক্ষুলজ্জার ভয়ে তা করতে নারাজ এবং এ কারণেই এখন ধুয়া তুলছে যে চুক্তির রদবদল প্রয়োজন।
অন্যদিকে মিনস্ক চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একেবারেই আগ্রহী না হওয়ার কারণও সহজেই বোধগম্য। চুক্তির সঙ্গে ওয়াশিংটন কোনোভাবেই সম্পর্কিত না থাকায় মার্কিন প্রশাসন সম্ভবত এ রকম ভেবে নিয়েছে যে মিনস্ক চুক্তি বর্তমান কাঠামোয় কার্যকর হলে ইউক্রেন সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়ায় দেশটির বড় কোনো ভূমিকা হয়তো থাকবে না। এ রকম হিসাব–নিকাশ থেকে মার্কিন সংবাদমাধ্যমও সেই ইরাক যুদ্ধের সময়ের মতোই সেঁটে আছে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আঁচল ঘেঁষে। তাই সেই কর্দমাক্ত ভূমিতে পা ফেলার সুযোগ ‘শান্তি’ এখন একেবারেই পাচ্ছে না। যদিও আমরা জানি বৈশ্বিকপর্যায়ের আসন্ন কোনো বিপদ এড়িয়ে যেতে হলে শান্তির জন্য সেই সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে সবার আবশ্যকীয় কর্তব্য।
মনজুরুল হক, জাপানপ্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক