সব মিলিয়ে ইউক্রেনকে ঘিরে ইউরোপে এখন উত্তেজনা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় কিছু সাধারণ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আচমকা রাশিয়ার হাতে এত শক্তি কোত্থেকে এল যে তারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর দেশগুলোর সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি–ধমকি দেওয়ার সাহস পাচ্ছে? হঠাৎ রাশিয়ার ইউক্রেনের সীমানার কাছে এত সৈন্যসামন্ত জড়ো করার দরকার পড়ল কেন? এটা কি অতি সাম্প্রতিক ঘটনার জের, নাকি এর পেছনে ঐতিহাসিক পটভূমি কোনো কাজ করছে? পুতিন আসলে চাইছেনটা কী? তিনি কি ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর এখন পুরো ইউক্রেনকেই গিলে ফেলতে চাইছেন, নাকি এসব ভয়ভীতি দেখিয়ে পশ্চিমাদের কাছে থেকে নিজের চাওয়াগুলোকে ‘পাওয়াতে’ পরিণত করার মতলবে আছেন? রুশ বাহিনী যদি সত্যি সত্যি ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে, তাহলে ন্যাটো কি সে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে? মানুষ এ ধরনের প্রশ্নের জবাব খুঁজছে। চলুন কিছু জবাব খুঁজি।
সংকটটা আসলে কী নিয়ে
গন্ডগোলের কারণ বুঝতে আগে গোড়ায় যাওয়া দরকার। ইউক্রেন সংকটের সেই ‘গোড়া’ হলো ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল। ক্রিমিয়া দখলেরও একটি ‘গোড়ার’ ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসেও নজর দেওয়া দরকার।
‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই’—ইউক্রেন ইস্যুতে রবীন্দ্রনাথের এই কথা যে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকালেই বোঝা যাবে।
ইউক্রেন যখন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল, তখন প্রায় ২০০ বছর ধরে রাশিয়ার মালিকানায় থাকা ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে ইউক্রেনের মালিকানায় দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ‘অধিকার ছাড়িয়া দিবার’ এই কাজ করেছিলেন। তখন তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, কয়েক দশকের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং তখন ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সত্যিই ভেঙে গেল এবং ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ ছুটে গেল, তখন মস্কো আবার ‘অধিকার রাখিতে যাইবার’ চেষ্টা শুরু করল এবং তখন থেকেই ইউক্রেনের সঙ্গে তার ‘বিড়ম্বনা’র শুরু।
সোভিয়েত থেকে বেরিয়ে ইউক্রেন স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ হওয়ার পর তাদের ভেতরকার জনগণের মধ্যে দুই ধরনের শিবির গড়ে ওঠে। ইউক্রেন রাশিয়ার লাগোয়া এলাকা বলে সেখানে অনেক জাতিগত রুশ নাগরিকের বাস। সেই রুশ নাগরিকেরা সব সময় রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছে। অন্যদিকে, বাকিরা ইউরোপসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছে। পশ্চিমাপন্থীরা চেয়ে আসছে, ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত হোক। একই সঙ্গে তারা ন্যাটোভুক্ত হোক। এই ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের যুক্ত হতে চাওয়াতেই রাশিয়ার আপত্তি এবং তখনই ‘বিড়ম্বনা’ থেকে বিতণ্ডার শুরু হয়।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। এতে ইউক্রেনের বেশির ভাগ মানুষ খুশি হয়েছিল। কারণ, এই চুক্তিগুলো হলে দেশ আরও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি পাবে। ইউক্রেনবাসী খুশি হলেও ইয়ানুকোভিচের এ উদ্যোগ পুতিনকে বিচলিত করে ফেলে। কারণ সেই চুক্তিটি হয়ে গেলে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়া সহজ হয়ে যাবে। আর ইউক্রেন ইইউর সদস্য হয়ে গেলে একসময় রাশিয়ার ঘোর শত্রু ন্যাটোরও সদস্য হয়ে যাবে।
এ চিন্তা থেকেই ইয়ানুকোভিচের ওপর পুতিন এমন চাপ দিলেন যে ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে সেই চুক্তির আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেলেন। এত বড় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ইয়ানুকোভিচ নষ্ট করে দিলেন কেন?—এ প্রশ্ন রেখে ইউক্রেনবাসী বিক্ষোভ করলে ইয়ানুকোভিচের পতন হয় এবং তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
এরপর ইউক্রেনের ভেতরে যেসব এলাকায় জাতিগত রুশ লোকের বসত, সেখানে পুতিন ইউক্রেন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ উসকে দেন। বিদ্রোহীরা ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে। পুতিন এই বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে যে সেনাবাহিনী পাঠান, তারা ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে এবং পুতিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার নিজের ভূখণ্ড বলে ঘোষণা করেন।
এরপরই ‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার’ আসল ‘বিড়ম্বনা’ শুরু হয়ে যায়।
ওই অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য ঠেকাতে ন্যাটো ধীরে ধীরে সেনা মোতায়েন বাড়াতে থাকে। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর একের পর এক ন্যাটোতে যোগ দিয়েছিল চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও আলবেনিয়া।
এই দেশগুলো একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য ছিল। এদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইছে জর্জিয়া, মলদোভা ও ইউক্রেন। কিন্তু সেখানে রুশপন্থী সশস্ত্র মিলিশিয়াদের শক্ত ঘাঁটি আছে এবং রাশিয়া তাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ওই মিলিশিয়াদের কারণে তারা ন্যাটোতে যোগ দিতে পারছে না।
ইউক্রেন ন্যাটোয় যোগ দিলে রাশিয়ার কী ক্ষতি
আছে। ক্ষতি আছে। আর সেই ক্ষতি বেশ বড় ধরনের। সে কারণেই ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৮ হাজার ২৪৬ বর্গকিলোমিটারের বিশাল রাশিয়া মরিয়া হয়ে মাত্র ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের পুঁচকে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।
রাশিয়া দেশ হিসেবে বিশাল বড় হলেও সারা বছর সচল রাখা যায় উষ্ণ পানির এমন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর তাদের প্রায় নেই। কিন্তু ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌঘাঁটি গেড়েছে, সেখানে সে ধরনের উষ্ণ পানি আছে। আর রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরে ঢোকার একমাত্র পথও হলো এই বন্দর। এ কারণে ক্রিমিয়ার অবস্থানগত মূল্য অনেক। ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্য হয়, তাহলে সেখানে ন্যাটো বাহিনীর আনাগোনা শুরু হবে। আর সেটি হলে কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার যাওয়া–আসা আগের মতো সহজ থাকবে না।
কাজেই ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়া রাশিয়ার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এর আগে যতবার পোলিশ, সুইডিশ, ফরাসি, জার্মানসহ অন্যান্য বিদেশিদের আক্রমণের মুখে রাশিয়া পড়েছে, তার সবগুলোই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে। এ কারণে ওই অঞ্চলের দিকে রাশিয়াকে বাড়তি নজর দিতে হচ্ছে।
পুতিন আসলে কী চান
সোজা কথায় পুতিন চান ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। তিনি পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে এ নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন যে ন্যাটো আর এ অঞ্চল থেকে নতুন করে কোনো দেশকে সদস্য করবে না। কিন্তু পশ্চিমারা তাতে রাজি হয়নি। পুতিন মনে করছেন, পশ্চিমারা ন্যাটোর বাহিনী দিয়ে চারদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে। এ কারণে তিনিও পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
পুতিনের খুঁটির জোর কোথায়
রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জোর হলো তার জ্বালানি। ইউক্রেনের মধ্য দিয়েই পাইপলাইনে করে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস যায়। এ গ্যাস সরবরাহ যদি রাশিয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউরোপের বহু বাড়িতে রান্নার চুলা পর্যন্ত জ্বলবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো যে চারটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে, সেগুলো হলো রাশিয়া, নরওয়ে, আলজেরিয়া ও কাতার। এর মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে আসে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। মানে, প্রায় অর্ধেক। রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয় ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ কাঠ ও কয়লা আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে।
লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়া রাশিয়ার জ্বালানির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় এ পাইপলাইন দিয়ে।ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো যদি ‘বৈরী আচরণ’ করে, তাহলে রাশিয়া এসব সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। এতে গোটা ইউরোপ মহাদেশ বেকায়দায় পড়ে যাবে।
যুদ্ধ কি সত্যিই বাধবে?
সে ধরনের আশঙ্কা একদম নেই— এমনটি বলা যাচ্ছে না। তবে যুদ্ধের আশঙ্কা ফিকে পর্যায়ে আছে। এখনো গাঢ় হয়নি। উভয় শিবির থেকে শক্ত শক্ত কথা ছোড়া হচ্ছে বটে; কিন্তু সেই শক্ত কথার মধ্যে আপস ও সমঝোতার একটি প্রচ্ছন্ন সুরও দেখা যাচ্ছে।
সব ধরনের সংবাদমাধ্যম বলছে, রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের সীমানা ঘেঁষে লাখখানেক সেনা মোতায়েন করে ফেলেছে। সেখানে আরও ভারী সাঁজোয়া যান ও জঙ্গি কপ্টার জড়ো করা হচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদিও–বা বলছেন, ইউক্রেনে ঢোকার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই; সে কথায় ভরসা পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের নিয়ে গঠিত জোট ন্যাটো।
বাইডেন পশ্চিম ইউরোপে আগে থেকে মোতায়েন করা মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে নতুন আরও কিছু সেনা যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ শনিবার বলেছেন, রোমানিয়ায় অবস্থানরত ন্যাটো বাহিনীতে তারা আরও সেনা পাঠাচ্ছেন। আর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, পূর্ব ইউরোপে তাঁদের আগে থেকেই ১ হাজার ১৫০ জন সেনা মোতায়েন করা আছে। এক সপ্তাহের মধ্যে সেই সংখ্যা দ্বিগুণ করে ফেলা হবে।
আর যে দেশকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই ইউক্রেনের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো নেতাদের ‘শক্ত হয়ে’ রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু ন্যাটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ গত শনিবার বলেছেন, ইউক্রেন যেহেতু ন্যাটোবহির্ভূত দেশ, সে কারণে সে দেশে রাশিয়া আগ্রাসন চালালেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধে সেনা পাঠাতে পারবে না। সে ধরনের কোনো পরিকল্পনাও তাদের নেই। অর্থাৎ ন্যাটোর দিক থেকে রাশিয়ার প্রতি আপাতত হুমকি দেখা যাচ্ছে না।
তবে শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]