ইউক্রেন যুদ্ধ এখন বিশ্বের অগ্রাধিকারমূলক বিষয়। সেটাই হওয়া উচিত। রাশিয়ার আগ্রাসন জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী। ইউক্রেনের জনগণের ওপর এখন যেটা ঘটছে, সেটা অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা। কিন্তু ইউক্রেনের পাশাপাশি আমাদের বিশ্বের অন্য প্রান্তের কথা ভুলে গেলে চলবে না। বিশ্বের অনেক মানুষ এখন অবিরাম সহিংসতা ও অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। এই দিক বিচারে ইয়েমেন এমন একটি দেশ, যেখানে পরিস্থিতিটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাত বছর ধরে ইয়েমেনে যুদ্ধ চলছে। গত জানুয়ারি মাসটি ছিল দেশটির বেসামরিক নাগরিক হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভীতিকর একটি মাস। যুদ্ধের ফলে ইয়েমেনের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং জনগণের মৌলিক সেবা ভেঙে পড়েছে।
গত বছর আমরা সতর্ক করেছিলাম, ইয়েমেনে খাদ্যসংকট ভয়াবহভাবে বাড়বে। আন্তর্জাতিক দাতারা ইয়েমেনে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দিয়েছে। তাদের ধন্যবাদ যে তাদের কারণে ইয়েমেনের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিটা এড়ানো গেছে। কিন্তু ইয়েমেন সংকটটা যদি জিইয়ে থাকে, তাহলে এই ‘সমুদ্রসম ক্ষুধা’ কখনোই কাটবে না। ইয়েমেনের সংকট মানবসৃষ্ট। যুদ্ধ বন্ধ করাটাই এখন সবচেয়ে কার্যকর মানবিক কাজ। ইয়েমেনের জনগণের জন্য সবচেয়ে টেকসই ত্রাণ হতে পারে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে একটা রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে পৌঁছানো। জাতিসংঘের বিশেষ দূত হান্স গ্রুন্ডবার্গ এ বিষয়ে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তাতে আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
ইয়েমেনে যুদ্ধ থামানোর প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আরও বেশি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সেখানকার অর্থনীতি ও মৌলিক সেবার খাতগুলো পুনর্গঠনের জন্য বিশ্বকে আরও বেশি সহযোগিতা দিতে হবে।
আবার ইয়েমেনের অর্থনীতি ক্রমাগত ভেঙে পড়ায় প্রতিনিয়ত আরও বেশিসংখ্যক মানুষ দুর্ভোগে পড়ছেন। জরুরি ত্রাণসহায়তার চেয়েও এখন ইয়েমেনের অর্থনীতির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমদানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে এবং সেখানে বিনিয়োগ শুরু করতে হবে।
মার্চের ১৬ তারিখে জাতিসংঘ, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেন যৌথভাবে ইয়েমেনের জন্য ত্রাণ তহবিল গঠনের একটা সভা ডাকে। ইয়েমেনের ১ কোটি ৭২ লাখ মানুষকে খাদ্য ও অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়ার জন্য ২০২২ সালে ৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, বর্তমানে ইয়েমেনের জন্য এত কম সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে যে মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো ত্রাণ কার্যক্রম কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ দুই-তৃতীয়াংশ সহায়তা কর্মসূচি কাটছাঁট করেছে কিংবা বন্ধ করে দিয়েছে।
সামনের সপ্তাহগুলোয় ৮০ লাখ মানুষের খাদ্য রেশনিং অনিয়মিত হয়ে পড়বে। আর ৫০ লাখ মানুষের খাদ্যসহায়তার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইয়েমেনে খাদ্যসংকট আরও বাড়বে। কেননা, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। আর ইয়েমেন রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করা খাদ্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
ইয়েমেন সংকটে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির মধ্যে আছেন নারী ও কন্যাশিশুরা। ত্রাণসহায়তা সংস্থাগুলো সেখানে কার্যক্রম সীমিত করায় তাঁদের পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা থেকে সুরক্ষার যে সেবা তাঁরা পান, সেটা কমে যাবে। ১০ লাখ নারী প্রজননস্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। ইয়েমেনে এখনই গর্ভধারণ জটিলতা ও সন্তান জন্মদানকালে প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।
ইয়েমেনে মানবিক সহায়তা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা যখন বাড়ছে, তখনই সেটা কমিয়ে দিতে হচ্ছে। বিশ্ব যদি ইয়েমেনের জন্য আরও সহায়তা দেয়, তাহলেই কেবল মানবিক সহায়তা বাড়ানো সম্ভব। গত বছর প্রায় ২০০টি মানবিক সহায়তা সংস্থা ইয়েমেনের ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের কাছে প্রতি মাসে খাবার, পরিষ্কার পানি, চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষাসেবা পৌঁছে দিয়েছে। এই জীবনরক্ষাকারী কার্যক্রম অব্যাহত রাখা গেছে। কেননা, দাতারা তাদের নিজের দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ইয়েমেনের জনগণের পাশে উদারভাবে দাঁড়িয়েছিল। সেই উদারতা আবার দেখানো প্রয়োজন।
তবে এটাও সত্য যে আরও বেশি অর্থের জোগান হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। ইয়েমেনে ত্রাণ বিতরণ সত্যিই খুব কঠিন। দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো খুব চ্যালেঞ্জের। এ ছাড়া প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই। সে কারণে সহায়তাকর্মীদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, আবার ত্রাণসহায়তা দেওয়ার সময়ও তারা নাক গলায়। এত সব প্রতিবন্ধকতার পরও জাতিসংঘ, দাতা সংস্থা ও অন্যান্য অংশীজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটা সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। দাতা সংস্থাগুলোর জন্য আমরা ভালো পরিবেশের সৃষ্টি অব্যাহত রাখতে পারি, যাতে করে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা সেখানে ভালোভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
আবার ইয়েমেনের অর্থনীতি ক্রমাগত ভেঙে পড়ায় প্রতিনিয়ত আরও বেশিসংখ্যক মানুষ দুর্ভোগে পড়ছেন। জরুরি ত্রাণসহায়তার চেয়েও এখন ইয়েমেনের অর্থনীতির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমদানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে এবং সেখানে বিনিয়োগ শুরু করতে হবে।
সরকারি খাতের চাকুরেদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়াও প্রয়োজন। আরও মানুষ যাতে গরিব না হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতের জন্য জনপ্রশাসনব্যবস্থা যেন টিকিয়ে রাখা যায়, সে জন্য এ উদ্যোগ নিতে হবে। এটা ছাড়া কোনো উন্নয়ন কিংবা পুনর্গঠন কল্পনা করা অসম্ভব।
ইয়েমেনে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক, মানবিক ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতা প্রয়োজন। ইয়েমেনের জনগণের কাছে আমাদের বার্তা দেওয়া প্রয়োজন যে আমরা তোমাদের পাশে আছি।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
মার্টিন গ্রিফিথস জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমবিষয়ক সহকারী মহাসচিব
অ্যান লিন্ডে সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইগনাযিও ক্যাসিস সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্রবিষয়ক দপ্তরের সভাপতি ও প্রধান