কোনো প্রমাণ ছাড়াই রাশিয়া দাবি করেছে, ইউক্রেনে জৈব অস্ত্রের গবেষণাগার পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এই দাবিকে অযৌক্তিক বলে নাকচ করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর নেতারা। তাঁরা সতর্ক করেছেন যে এই অজুহাত তুলে ক্রেমলিন রাসায়নিক কিংবা জৈব অস্ত্র ব্যবহার করে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইউক্রেনকে নিকেশ করে দেওয়ার মতলব আঁটছে। ইউক্রেন সরকার এর আগে দাবি করেছিল, তাদের দেশে জনস্বাস্থ্য গবেষণাগার আছে। প্রাণী ও মানুষের মধ্যে ভয়ানক রোগের বিস্তার ঠেকানোর গবেষণা হয় সেখানে।
রাশিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ মার্চ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে একটি সভা ডাকে। কিন্তু সেখানে রাশিয়া তাদের দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের দপ্তর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে ১৯৭৫ সালের ‘জৈব অস্ত্র কনভেনশন’-এর ব্যাখ্যা তুলে ধরে। কোনো সদস্যরাষ্ট্রের অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্দেহ তৈরি হলে সেটা ‘পরামর্শ সভা’-এর মাধ্যমে কীভাবে নিরসন করা যাবে, সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ‘পরামর্শ সভা’ হবে, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউক্রেনের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা ব্যাখ্যার ওপরেই বেশি আস্থা রেখেছে। ইউক্রেনের জনস্বাস্থ্য গবেষণাগারে যেসব রোগজীবাণু নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, সেগুলো দ্রুত ধ্বংস করে ফেলার পরামর্শ তারা দিয়েছে। যুদ্ধকালে দুর্ঘটনাবশত কোনো জীবাণু গবেষণাগারের বাইরে যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্যই এ পরামর্শ।
এখন রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যাপারে কী হবে? ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি কতখানি? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার দিকে আমরা নজর দিতে পারি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় সেখানে কয়েক দফায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার হয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের একটি কমিটি তদন্ত করে খুঁজে পায়, দামেস্কের উপকণ্ঠের শহর ঘুটাতে নার্ভ এজেন্ট সারিন প্রয়োগ করা হয়েছিল। এতে ১৪ হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
রাসায়নিক অস্ত্রের এই ব্যবহার শুধু সিরিয়াতে সীমাবদ্ধ নেই। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের মাটিতে রাশিয়ান সাবেক এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ের শরীরে নার্ভ এজেন্ট নভিচক ব্যবহার করা হয়েছিল। রাশিয়ার বিরোধী দলের নেতা আলেক্সেই নাভালনির শরীরেও নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সৎ ভাইকে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে নার্ভ এজেন্ট ভিএক্স প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তির পর সিরিয়া তাদের রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত ধ্বংস করতে সম্মত হয়। রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংস্থায় (ওপিসিডব্লুউ) যোগ দেয় সিরিয়া। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তদন্ত কমিটি সিরিয়ার আরও কয়েকটি স্থানে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ নিয়ে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের জুন মাসে ওপিসিডব্লিউ তদন্ত ও শনাক্তকরণ কমিটি গঠন করে। এই কমিটি খুঁজে পায়, সিরিয়ার সরকার বেশ কয়েকটি রাসায়নিক হামলার জন্য দায়ী।
এ প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালে ওপিসিডব্লিউতে সিরিয়ার ভোট দেওয়ার ক্ষমতা স্থগিত করা হয়। তবে রাশিয়ার বিরোধিতার মুখে নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ২০১৫ সালে থেকে রাশিয়া যেকোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে সিরিয়ার সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছে। রাশিয়া ও আরও কিছু দেশ ওপিসিডব্লিউর সম্মানহানির জন্য সম্মিলিত প্রচারণা শুরু করেছে। তাদের দাবি, তদন্ত কমিটির তথ্যে ভিন্নতা আছে। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে সিরিয়ার সরকারের ভূমিকা নিয়ে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তারা নানা মনগড়া তথ্য উপস্থাপন করেছে। একটা বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিবেদনকে তারা উড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়া দাবি করেছে, সিরিয়ার রাশিয়া-সমর্থিত সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্য বিরোধী পক্ষগুলো রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
সিরিয়ার সরকার যুক্তি দিয়েছিল, তাদের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কেননা, বিদ্রোহী দলগুলোকে পরাজিত করার মতো পর্যাপ্ত প্রথাগত অস্ত্রের মজুত তাদের রয়েছে। কিন্তু সামরিক বিশেষজ্ঞদের মত ভিন্ন। তাঁরা মনে করেন, সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনী যেসব এলাকায় শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, সে সব এলাকায় রাসায়নিক অস্ত্রের হামলা চালিয়েছে। বেসামরিক জনগণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা, বিরোধী বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং নিজ সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে কোনো এলাকার দখল নেওয়ার জন্য রাসায়নিক অস্ত্রের হামলা চালিয়েছিল তারা।
রাসায়নিক অস্ত্রের এই ব্যবহার শুধু সিরিয়াতে সীমাবদ্ধ নেই। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের মাটিতে রাশিয়ান সাবেক এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ের শরীরে নার্ভ এজেন্ট নভিচক ব্যবহার করা হয়েছিল। রাশিয়ার বিরোধী দলের নেতা আলেক্সেই নাভালনির শরীরেও নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সৎ ভাইকে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে নার্ভ এজেন্ট ভিএক্স প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।
সোভিয়েত উত্তরাধিকারসূত্রে রাশিয়ার হাতে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্র এসেছিল। ওপিসিডব্লিউর সদস্য হিসেবে অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়াও অঙ্গীকার করেছিল যে তারা সব রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত ধ্বংস করবে। কিন্তু রাশিয়া নভিচকের (যদিও খুব অল্প পরিমাণ) প্রয়োগ করায় সন্দেহ থেকেই যায় তাদের কাছে রাসায়নিক অস্ত্রের কিছু মজুত এখনো রয়ে গেছে কি না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধ যদি চলতেই থাকে, তাহলে রাশিয়া কি ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করবে? এই শঙ্কা যদি বাস্তবে সৃষ্টি হয়, তাহলে ওপিসিডব্লিউর ‘কর্তৃত্বের যে পরিধি’, তাতে কি রাশিয়াকে বাধা দেওয়া সম্ভব? রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছে কি না, সেটা পরীক্ষা করার উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি এখন ওপিসিডব্লিউর হাতে রয়েছে। সদস্যরাষ্ট্রগুলো রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার আর যাতে না হয়, সে ব্যাপারেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
২০১৮ সালের জুন মাসে ওপিসিডব্লিউর সভায় সংস্থাটির মহাসচিব হিসেবে আমি বক্তব্য দিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, ‘বিশ্বের যেখানেই রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ হোক না কেন, সেটা গুরুতর অপরাধ। দ্রুত সেটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।’ আমি আরও বলেছিলাম, ‘যদি আমাদের সবার ভেতরে স্বচ্ছতা না থাকে, তবে যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব নয়।’
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমি আমার সেই বক্তব্যকে আবার সমর্থন করছি। কোনো একটি রাষ্ট্র যদি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি তৈরি করে, তবে সেই রাষ্ট্রকে রুখে দেওয়ার দায়িত্ব বাকি সব রাষ্ট্রের; কিন্তু সেটা করতে যদি সবাই ব্যর্থ হয়, তবে দায়টা খুঁজে বের করতে হবে।
স্বত্ব : প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ মনোজ দে
আহমেট উজুমচু, রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংস্থার সাবেক মহাসচিব