ইউক্রেন যুদ্ধকে নিজের অপকর্মের ঢাল বানাচ্ছেন এরদোয়ান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ছবি: এএফপি

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তাঁর নিজের দেশে গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা দ্বিগুণ করেছেন। সেখানে তিনি ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছেন। কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে তিনি একজন শান্তিকামী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ তাঁকে এ অঞ্চলে একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হিসেবে নিজেকে জাহির করার সুযোগ দিয়েছে। অথচ তাঁর পীড়নে তুরস্কে অনেকের জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

তুরস্কের বিশিষ্ট জনহিতৈষী ও নাগরিক-সমাজকর্মী ওসমান কাভালার দুর্দশার কথাই ধরুন। তিনি একটি মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চার বছর পরে তাঁর সেই মামলা পুনরুজ্জীবিত করে রায় দেওয়া হয়েছে। ওই মামলায় কোনো রকম প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সম্ভাবনা ছাড়াই তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এরদোয়ান নিয়ন্ত্রিত আদালতের রায়ে তিনি আবার কারারুদ্ধ হয়েছেন।

রাশিয়া সরকার তাদের দেশের ভিন্ন মতাবলম্বী নেতা আলেক্সি নাভালনির সঙ্গে উৎপীড়নমূলক আচরণ করেছে এবং সরকার বিরোধিতার কারণে রাশিয়ার আদালত সম্প্রতি তাঁকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। কিন্তু কাভালার ওপর তুরস্ক সরকারের নিপীড়ন কাভালার প্রতি রাশিয়ার নিপীড়নকেও ছাড়িয়ে গেছে।

তুরস্ক কাভালাকে এমন জায়গায় নিক্ষিপ্ত করেছে, যাকে হান্না আরেন্ত বলেছেন ‘বিস্মৃতির গর্ত যা সর্বগ্রাসী শাসকেরা তাঁদের বিরোধীদের জন্য তৈরি করেন।’ নিরবচ্ছিন্ন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাগরিক ভাবমূর্তি ও সামাজিক পরিচয়কে জনমন থেকে শুধু নিশ্চিহ্ন করে না, নিরলসভাবে তিনি যে ভাষ্য বুনেছিলেন, তা–ও তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতির মাধ্যমে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলা হয়।

ওসমান কাভালা
ছবি: এএফপি
কাভালার গ্রেপ্তার, আটক এবং বিচারপ্রক্রিয়ার অনিয়ম এতটাই মারাত্মক যে সেই অনিয়মগুলো তুরস্ককে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসের (ইসিটিএইচআর) সঙ্গে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের মধ্যে নিয়ে এসেছে এবং ইউরোপ কাউন্সিলে থাকা দেশটির সদস্যপদকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতা আবদুল্লাহ ওকালানকে দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং কুর্দিশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (এইচডিপি) নেতা সেলাহাতিন দেমিরতাসের বিচারহীন দীর্ঘ আটকাবস্থার সঙ্গে কাভালার সাজার তুলনা করা হয়। কিন্তু কাভালা মোটেও ওকালান এবং দেমিরতাসের মতো রাজনীতিবিদ, সেনা বা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নন। কাভালা একজন সাধারণ নাগরিক, যিনি তুরস্কের নাগরিক সমাজে সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং দেশটিতে স্বাধীন সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক ফোরাম গড়ে তুলতে সাহায্য করছিলেন।

কাভালা ‘আনাদোলু কুল্টুর’ নামের একটি সংগঠন গড়েছিলেন এবং ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন, টার্কিশ ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল স্টাডিজ ফাউন্ডেশন, তুর্কি অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্টাডিজ ফাউন্ডেশন এবং হিস্ট্রি ফাউন্ডেশন (তারিহ ভাকফি) এবং আরও কিছু সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন।

আরও পড়ুন

মানবাধিকার এবং বহু-সাংস্কৃতিকের পক্ষে কাজ করার জন্য কাভালা নিউইয়র্কের নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চের পক্ষ থেকে ২০২১ সালে কারেজ ইন পাবলিক স্কলারশিপ পুরস্কারে ভূষিত হন। প্রয়াত দার্শনিক অ্যাগনেস হেলার, পোলিশ ইতিহাসবিদ জ্যান টি গ্রস এবং আমেরিকান নারীবাদী আন্দোলনকর্মী প্রয়াত অ্যান স্নিটো ইতিপূর্বে এই সম্মাননা পেয়েছেন।

২০২০ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির বিজয়ের পর মনে হচ্ছিল, ১৯২০ সালের গোড়ার দিকে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক যে ধর্মনিরপেক্ষ অথচ দমনমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা থেকে সুশীল সমাজ মুক্তি পেয়েছে।

কাভালা তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের বহু-সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে আলিঙ্গন করেছিলেন। তিনি সেই বহু-সংস্কৃতিভিত্তিক অবস্থাকে পুনরায় তুরস্কে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন, যা একসময় আর্মেনিয়ান, গ্রিক, কুর্দি, আলেভি (শিয়াদের একটি ধারা), ইহুদি এবং শেরকেসিয়াদের তুরস্কজুড়ে অবাধে তাদের স্মৃতিস্তম্ভ, সংগীত, রন্ধনপ্রণালি এবং নিজ নিজ সংস্কৃতি প্রসারের অনুমোদন দিত।

জাতীয়তাবাদবিষয়ক ফরাসি ইতিহাসবেত্তা আর্নেস্ট রেনান যেখানে বিশ্বাস করতেন, একটি জাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্য অতীতের হিংসা ভুলে যাওয়া প্রয়োজন, সেখানে কাভালা বিশ্বাস করেন, তুর্কি সমাজকে গণতন্ত্রমুখী করতে সব সংস্কৃতির সহাবস্থান প্রয়োজন।

কাভালার গ্রেপ্তার, আটক এবং বিচারপ্রক্রিয়ার অনিয়ম এতটাই মারাত্মক যে সেই অনিয়মগুলো তুরস্ককে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসের (ইসিটিএইচআর) সঙ্গে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের মধ্যে নিয়ে এসেছে এবং ইউরোপ কাউন্সিলে থাকা দেশটির সদস্যপদকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

কারাগারে চার বছরের বেশি সময় আটক থাকার সময় কাভালার বিরুদ্ধে হিংসাত্মক বিদ্রোহ থেকে শুরু করে একটি অভ্যুত্থানের উসকানি দেওয়া এবং গুপ্তচরবৃত্তির একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে।

এর আগে ২০১৯ সালের মে মাসে কাভালার বিরুদ্ধে করা মামলাটি নিয়ে তুরস্কের সাংবিধানিক আদালতের বিচারকেরা অস্বাভাবিক বিভক্ত রায় দিয়েছিলেন। মোট ১০ বিচারকের মধ্যে প্রধান বিচারপতি জুহতু আর্সলানসহ মোট ৫ জন কাভালার পাশে ছিলেন। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কাভালাকেগেজি পার্কের বিক্ষোভে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপর তাঁকে গুপ্তচরবৃত্তি এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।

ইসিটিএইচআর কাভালার বিরুদ্ধে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করতে তুরস্কের প্রতি অনুরোধ জানালে তুরস্ক তা করতে অস্বীকার করে। কাউন্সিল অব ইউরোপ কমিটি অব মিনিস্টারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রায় প্রকাশ না করলে তারা তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইটিসিএইচআরকে সমর্থন দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ ১০টি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতকে তুরস্ক থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছে এরদোয়ান সরকার। ওই হুমকি পশ্চিমাদের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ককে একেবারে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে।

ইউক্রেনের যুদ্ধ এরদোয়ানকে অবশেষে কাভালাকে আজীবন কারাগারে রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এই অঞ্চলে তুরস্ক কেন্দ্রীয় জায়গায় আছে এবং যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে বিপর্যস্ত ইউক্রেনীয়দের কাছে আঙ্কারা ড্রোন বিক্রি করেছে—এই দুটি বিষয় তুরস্ককে পশ্চিমের কাছে একটি অপরিহার্য অংশীদার করে তুলেছে। অন্যদিকে ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই তুরস্কের বাণিজ্য–সম্পর্ক ভালো। এটি এরদোয়ানকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের দ্বন্দ্বে মধ্যস্থতাকারী হতে সহায়তা করেছে।

যুদ্ধের কুয়াশা যত ঘনীভূত হচ্ছে, কাউন্সিল অব ইউরোপ কমিটি অব মিনিস্টারস তুরস্কের ওপর যথাযথ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে কি না, তা নিয়ে তত সংশয় দেখা দিচ্ছে। সম্ভবত তুরস্কের পশ্চিমা মিত্ররা এরদোয়ানকে দায়মুক্তি দেওয়ার অজুহাত খুঁজে পাবে এবং ৬০–এর কোঠায় থাকা কাভালা নামের একজন অধিকারকর্মী বিস্মৃতির অতল গহ্বরে অদৃশ্য হয়ে যাবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সায়লা বেনহাবীব ইয়েল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং কলম্বিয়া ল স্কুলের সিনিয়র স্কলার ইন রেসিডেন্স।