আমরা একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত ও মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও তা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে আজ ৯ আগস্ট বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ-ঘোষিত ২৩তম আদিবাসী দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজল্যুশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং তা পালনের জন্য সদস্যরাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান জানায়। আদিবাসী দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য হলো আদিবাসীদের জীবনধারা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্যরাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ অ-আদিবাসী জনগণসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা এবং তাদের অধিকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করা।
এ বছর আদিবাসী দিবসের মূল সুর ‘জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্রের এক দশক’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘোষণাপত্র বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি জীবন্ত আন্তর্জাতিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কেননা, এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিকার, শিক্ষার অধিকার, নিজেদের মিডিয়া প্রতিষ্ঠার অধিকার, নাগরিকত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অধিকারের সমতা, মর্যাদা, আদিবাসী নারী, তরুণ, শিশু ও প্রবীণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষা, চাকরি, কারিগরি প্রশিক্ষণ ইত্যাদি স্থান পেয়েছে।
আমাদের দেশে জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে। কেননা, এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়।
আদিবাসী ইস্যুতে পৃথিবীর অনেক দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। নরওয়েসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কয়েকটি দেশে আদিবাসীদের পার্লামেন্ট আছে। নেপাল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশ চেষ্টা করছে আদিবাসীদের অধিকার প্রদানের। অস্ট্রেলিয়া সরকার অতীতের ভুল আচরণের জন্য পার্লামেন্টে আদিবাসীদের কাছে ঐতিহাসিক ক্ষমা চেয়ে বলেছে, ‘এই ক্ষমা প্রার্থনা ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে আমরা একে অপরের যাতনা বুঝতে পারব এবং সামনে অগ্রসর হতে পারব।’ আমেরিকা, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড সরকারও তাদের অতীতের ভুল আচরণের জন্য আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে।
দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। বলিভিয়া জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রকে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করেছে। পেরুতে ওয়াম্পি জাতির জন্য অটোনমাস টেরিটোরিয়াল গভর্নমেন্ট গঠিত হয়েছে, যেখানে আদিবাসী জনগণ ১৩ লাখ হেক্টর ভূমির ওপর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। মিয়ানমার ২০১৬ সালে তাদের পার্লামেন্টে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ভূমি অধিকার নীতি গ্রহণ করেছে। কেনিয়া সরকার ২০১৬ সালে ‘কমিউনিটি ল্যান্ড অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেছে। ২০১৬ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সে দেশের আদিবাসীদের কাছে রাষ্ট্রের চার দশকের বৈষম্যমূলক আচরণ ও দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। নামিবিয়াও ক্ষমা প্রার্থনা করেছে আদিবাসী জনগণের কাছে। পাকিস্তানেও প্রভিন্সিয়ালি (পাটা) এবং ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়া (ফাটা) আছে। স্বশাসনের সবচেয়ে ভালো নমুনা হলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহের আদিবাসী অঞ্চলগুলো।
আমাদের দেশেও এ বিষয়ে নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আদিবাসী দিবসের বাণীতে বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ-ঘোষিত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করা হবে।’ এখন সময় এসেছে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করার। আজ দেশের আদিবাসী তরুণ সমাজ ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। দেশে উচ্চশিক্ষিত আদিবাসী বেকারের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। শত শত আদিবাসী বেকার তরুণ। আদিবাসীদের পেছনে ফেলে ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’। জাতিসংঘ এসডিজি ২০৩০ গ্রহণের পর ‘লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’ কথাটি এখন বেশ আলোচিত হচ্ছে। অর্থাৎ কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। দেশ যে ধারায় পরিচালিত হচ্ছে, তাতে আদিবাসীদের বড় কোনো স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই। একটি ইনক্লুসিভ রাজনৈতিক সংস্কার
ছাড়া আদিবাসীসহ দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের জীবনে মুক্তি সুদূরপরাহত।
আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করার কথা বলা আছে (সংবিধানের সপ্তম তফসিল, অনুচ্ছেদ ১৫০-এর ২)। এ ছাড়া সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশে, ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের শাসন লাভের অধিকারী’। অতি দুঃখের বিষয়, আদিবাসী পাহাড়ি মানুষের জীবনে, দলিত সংখ্যালঘু, চা–শিল্পের জনগোষ্ঠীসহ দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জীবনে এসব সুন্দর কথার প্রতিফলন নেই। তবে নিশ্চয় আগামী দিনে আমরা সবার জন্য সমান সুন্দর ও সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ দেখতে পাব, যেখানে মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে এত প্রকট বৈষম্য থাকবে না।
আমাদের এই জন্মভূমি দেশে আসুন, আমরা এমন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও পদ্ধতি প্রবর্তন করি, যাতে ১৬ কোটি মানুষের দেশে অন্তত একজন সাঁওতাল, খাসিয়া, মণিপুরি, হাজং, চাকমা, গারো, ত্রিপুরা, ওঁরাও, মাহাতো, লুসাই-ম্রো-চাক-তঞ্চঙ্গ্যা-মারমা-রাখাইন, বর্মণ, বানাই, কোচ, মুন্ডা, মালো বা চা-শ্রমিকের সন্তান জাতীয় সংসদে এসে দেশের রং উজ্জ্বলতর করতে পারে। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে আদিবাসীদের জন্য এমন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে।
আমাদের দেশমাতা তার সব সন্তানকে সমান আদর, যত্ন ও ভালোবাসা দিতে পারছে না। তার অকৃত্রিম মায়া-মমতা অন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্তানদের দুর্ব্যবহারের কারণে পেছনে পড়ে থাকা সন্তানদের জন্য বিলিয়ে দিতে পারছে না। আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর ও বৈচিত্র্যময়। কারণ, এখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্খ-সোমেশ্বরী-মাইনী-খোয়াই নদী আছে। পদ্মাপারের বাঙালি যেমন স্বপ্ন দেখে, গান গায়, তেমনি গারো পাহাড়ের কোলে বুগাই নদীতীরের মানুষও স্বপ্ন দেখে, গান গায়। আসুন, এখানে সবার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করি। জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাই। আসুন, আজ আদিবাসী দিবসে এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করি, যেখানে একজন আদিবাসী শিশু আর বাঙালি শিশু আগামী দিনে সমান নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে হাতে হাত ধরে পথ চলতে পারে।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।