হুট করেই নাগরনো কারাবাখে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। আবার আচমকাই সংকটের দৃশ্যপটে রাশিয়া উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। নাগরনো কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের লড়াই বিগত ৩০ বছরের। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর শুরু হওয়া এই লড়াইয়ে উভয় দেশের ৩০-৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
সর্বশেষ ৬ সপ্তাহের এই যুদ্ধে জয় হলো কার? আজারবাইজান আর্মেনিয়াকে হারিয়ে দিল, নাকি ফ্রান্সের ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে তুর্কি ড্রোনের জয় হলো। অথবা এই অঞ্চলে রাশিয়া আরও একটি ঘাঁটি গড়ার সুযোগ পেল। ওদিকে কেবল আর্মেনিয়া একাই পরাজিত পক্ষ নয়। ফ্রান্সও মনে হয় পরাজিতের দলেই থাকবে। ছায়া যুদ্ধে ফ্রান্স তুরস্কের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
যুদ্ধবিরতির চুক্তির শর্তানুসারে মনে হবে, আপাত–সমঝোতায় আজারবাইজান লাভবান হয়েছে। দেশটির রাজধানী বাকুতে নাগরিকেরা উল্লাস করেছেন। বিপরীতে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানের রাজপথ ছিল বিক্ষোভকারীদের দখলে। বিক্ষুব্ধরা আজারিদের কাছে নাগরনো কারাবাখের বিভিন্ন এলাকা ছেড়ে দেওয়ায় স্বভাবতই খুশি হননি। প্রকৃতপক্ষে এবারের লড়াইয়ে লাভবান হলো রাশিয়া ও তুরস্ক। রাশিয়া ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যের সীমান্তে চলে আসছে। আর তুরস্ক আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান সংহত করছে।
যুদ্ধ–সংঘাত সব সময়ই জটিল। সাম্প্রতিক যুদ্ধ–সংঘাতগুলো আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এসব যুদ্ধে বিবদমান দলগুলোকে সরাসরি দুই ভাগে বিভক্ত করা কঠিন। সরাসরি বা আড়াল থেকে বিভিন্ন দেশ, গোষ্ঠী এমনভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে যে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নির্ণয় করা মুশকিল। নাগরনো কারাবাখে লড়াই এমনই এক জটিল যুদ্ধ। এই লড়াই শুধু আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা তুরস্ক, ফ্রান্স, ইরান ও রাশিয়ার লড়াই। ইরান, রাশিয়া ও ফ্রান্স আর্মেনিয়ার পক্ষে ছিল। ইরানের সঙ্গে আজারবাইজানের সীমান্ত ও কাস্পিয়ানের তেল–গ্যাস নিয়ে ঝামেলা অনেক দিনের পুরোনো। রাশিয়া চায়, নাগরনো কারাবাখ নিয়ে সমস্যা চলতেই থাকুক। এতে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান—দুই দেশকেই নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হবে। ওদিকে ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করতে চায় ফ্রান্স। নিজ নিজ স্বার্থে এই তিন দেশই আর্মেনিয়াকে অস্ত্র ও ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেছে। তবে সব থেকে বেশি উচ্চকিত ছিল ফ্রান্স।
আজারবাইজান যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই রাশিয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে দৃশ্যপটে উপস্থিত হয়। তুরস্ক এই চুক্তিকে আজারবাইজানের বিজয় বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
অন্যদিকে আজারবাইজানের পক্ষে ছিল তুরস্ক। তুরস্ক আজারবাইজানকে অস্ত্র ও লোকবল দিয়ে সহায়তা করেছে। বিস্ময়করভাবে আজারবাইজানের পক্ষে ইসরায়েলের নাম শোনা গেছে। যদিও ইসরায়েল দুই দেশের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করে। সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় চমক ছিল তুরস্কের সরবরাহ করা ড্রোন। এই ড্রোন ব্যবহার করে আজারবাইজান আর্মেনিয়াকে ঘায়েল করেছে। ফ্রান্সের নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্র তুর্কি ড্রোনকে তাড়া করলেও এর কার্যকারিতার বিষয়টি নাগরনো কারাবাখের আর্মেনীয় নেতাও স্বীকার করেছেন।
আজারবাইজান যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই রাশিয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে দৃশ্যপটে উপস্থিত হয়। তুরস্ক এই চুক্তিকে আজারবাইজানের বিজয় বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবে এটা শুধু আজারবাইজানের বিজয়ই নয়, তুরস্কেরও বিজয়। তুরস্ক বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে এখন লড়াই করছে। সিরিয়া, লিবিয়া ও ভূমধ্যসাগরে। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ককে কোনোভাবেই বাগে আনতে পারছে না পশ্চিমারা। ইউরোপের নানা হুমকি–ধমকিকে উপক্ষো করেই ভূমধ্যসাগরে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে জাহাজ পাঠিয়েছে। লিবিয়াতেও তুরস্ক সেনা পাঠিয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন যুদ্ধে তুরস্ক জড়িয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। ২০২৩ সালে লুজার্নের চুক্তি শেষ হবে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত তুরস্ককে নানাভাবে চাপে রাখতে চাইবে ইউরোপীয় দেশগুলো। সম্ভব হলে তুরস্ক ক্ষমতার পটপরিবর্তনের উদ্যোগ নেবে। এই অবস্থায় এরদোয়ানের তুরস্ক আক্রমণাত্মক ভূমিকা অবলম্বন করছে। সিরিয়া ও ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক খুবই আগ্রাসী ভূমিকা পালন করছে। তুরস্ক কখনোই সিরিয়ায় স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা মানবে না। শুধু কুর্দিস্তানই নয়, আশপাশেও পশ্চিমাদের উপস্থিতি তুরস্কের জন্য বিপজ্জনক হবে। তাই তুরস্ক শক্তির মহড়া দিচ্ছে। নাগরনো কারাবাখে সেই মহড়াই হয়ে গেল। তুরস্ক আক্রমণকেই সব থেকে ভালো রক্ষণকৌশল বলে মনে করছে।
এই কৌশলের অংশ হিসেবেই তুরস্ক নাগরনো কারাবাখ সংকটে সম্পৃক্ত হয়। এখানেই ফ্রান্সের সঙ্গে একটি ছায়াযুদ্ধ হয়ে গেল। ফ্রান্সের দিনকাল খুব ভালো যাচ্ছে না। দেশের অভ্যন্তরে নানা বিতর্ক, উগ্র দক্ষিণপন্থীদের ক্রমাগত উত্থান, সন্ত্রাসী হামলার কারণে হতাশাজনক এক সময় পার করছে। এ হতাশা কাটাতে ফ্রান্স আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুব হম্বিতম্বি শুরু করেছে। ফ্রান্স এখন ইসলামের সংকট খুঁজে বের করছে। একসময় ইউরোপীয়রা ইহুদিদের সংকট মনে করত। ইহুদি সংকট নিয়ে বীতশ্রদ্ধ ইউরোপ নিজেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যায়। ইসলামের সংকট নিয়ে ইউরোপ কোথায় পৌঁছায়, বলা মুশকিল। তবে ফ্রান্স খুব করে চাইছে, যেকোনো প্রকারে তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয় হয় করে হচ্ছে না। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের জাহাজ পাঠানোর প্রতিক্রিয়ার ফ্রান্স যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেখানে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হয়নি। এর আগে লিবিয়াতেও খুব বেশি কার্যকর হয়নি ফ্রান্সের নীতি ও কৌশল। ফ্রান্স যুদ্ধবাজ জেনারেল খলিফ হাফতার সমর্থন করছে। আর ওদিকে ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়ে সব তেলের খনি দখল করেছে রাশিয়া। এ ছাড়া তুরস্ক সৈন্য পাঠিয়ে লিবিয়ার জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকার সহায়তা করছে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিভিন্ন যুদ্ধের লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তুরস্ক ও রাশিয়া বিপরীত অবস্থানে থাকলেও উভয়ের মধ্যে একধরনের অলিখিত মিত্রতা কাজ করছে। নাগরনো কারাবাখের সংকটে ফ্রান্সের অনুপ্রবেশ যদি হয় তুরস্ককে দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধে যুক্ত করার হীন প্রয়াস, তবে সেই প্রয়াসের গোড়ায় পানি ঢেলে দিয়েছে রাশিয়া।
সর্বশেষ ফ্রান্স ককেশাসে নিজের অবস্থান শক্ত করার পাশাপাশি এমানুয়েল মাখোঁ রাজনীতিতে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এখানেও ফ্রান্স অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। সফলতা অর্জন করতে পারেনি। রাশিয়া আর্মেনিয়ার পক্ষে থাকলেও সম্ভবত চায়নি আর্মেনিয়া ফ্রান্সের সহায়তা নিয়ে নাগরনো কারাবাখের যুদ্ধে সফল হোক। তাহলে ফ্রান্স একেবারেই রাশিয়ার সদর দরজার কাছে চলে আসবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাশিয়া নাগরনো কারাবাখের সংকটে দুই পক্ষেই ছিল। রাশিয়ার উদ্দেশ্য সংকটের স্থায়ী সমাধান নয়; বরং এই সংকট জিইয়ে রেখে এই অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধি করা।
আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার বিমানঘাঁটি আছে। এখন নাগরনো কারাবাখেও নতুন করে ঘাঁটি গড়ে তোলার সুযোগ পাবে। চুক্তি অনুসারে আর্মেনিয়া নাগরনো কারাবাখের ৭ অঞ্চলের মধ্যে ৫টি আজারবাইজানের কাছে হস্তান্তর করবে। অন্য দুটিকে রাশিয়ার সৈন্যরা অবস্থান করবে। আজারবাইজান অবশ্য দাবি করেছে, রাশিয়ার সৈনিকদের সঙ্গে তুরস্কের সৈন্যরাও অবস্থান করবে। যদিও বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়।
নাগরনো কারাবাখে সৈন্য পাঠাতে না পারলেও মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনরে প্রভাব বৃদ্ধির দৌড়ে এখন পর্যন্ত তুরস্ক এগিয়ে রইল। নাগরনো কারাবাখ থেকে আর্মেনিয়ার পিছুটান তুরস্কের বিরুদ্ধে আর্মেনীয় গণহত্যার বৈশ্বিক প্রচারণা এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসবে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিভিন্ন যুদ্ধের লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তুরস্ক ও রাশিয়া বিপরীত অবস্থানে থাকলেও উভয়ের মধ্যে একধরনের অলিখিত মিত্রতা কাজ করছে। নাগরনো কারাবাখের সংকটে ফ্রান্সের অনুপ্রবেশ যদি হয় তুরস্ককে দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধে যুক্ত করার হীন প্রয়াস, তবে সেই প্রয়াসের গোড়ায় পানি ঢেলে দিয়েছে রাশিয়া। সিরিয়াতেও একই অবস্থা। সেখানে রাশিয়া ও ইরানকে পাশ কাটিয়ে কুর্দিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা পশ্চিমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে তুরস্ক বড় ধরনের যুদ্ধ ও সম্ভাব্য ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। তুরস্ক বিভিন্ন সংকটে জড়িয়ে পড়লেও এখন পর্যন্ত ভালোভাবেই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিজের শক্তির জানান দিচ্ছে। ভূমধ্যসাগর ও নাগরনো কারাবাখে তেমন ইঙ্গিতই মেলে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত যদি এই অবস্থা তুরস্ক বজায় রাখতে পারে, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনরের রাজনীতির মানচিত্র বদলে যাবে। আর যদি তা না হয়, তবে তুরস্ক নিজেই সংকটে নিপতিত হবে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক