বেশির ভাগ দেশেই জালিয়াতরা সাধারণ জনগণ এমনকি পেশাজীবী কিংবা নিয়ন্ত্রকদের চাইতেও এগিয়ে থাকে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অনিয়ম ও জালিয়াতি ঘটছে অনেক আগে থেকেই এবং প্রায় সব দেশেই, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত ও বিকাশমান দেশগুলোতে এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যেমন তা খুব একটা আমলে নেয়নি, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও নিয়ন্ত্রকদের অনীহা দেখা গিয়েছে। দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদনের কারণে অনেক অভিযুক্ত আবার খালাসও পেয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে, গত ১০ বছরে ২৮ হাজার কোটি টাকার অনিয়মে ১৪২ জনকে বিভিন্ন সময়ে মামলায় গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁদের বেশির ভাগই জামিনে রয়েছেন। ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অনিয়ম হলে অর্থনীতিতে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে ব্যাংক খাতের প্রসার যেমন ঘটেছে, তেমনি বেড়েছে এ খাতের অনিয়ম।
এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের কথা বেশি শোনা গেলেও আছে অনেক বেসরকারি ব্যাংকও। কিন্তু সে অনুযায়ী তদারকি জোরদার ও জালিয়াতির নিষ্পত্তি দ্রুত করা হচ্ছে না। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে তাই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং অর্থ বা আইন মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় হতে হবে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে জালিয়াতির অভিযোগে ইদানীং অনেক মামলা হলেও দুদক এখনো সব কটির তদন্ত শেষ করতে পারেনি। কবে শেষ হবে, তা-ও অনিশ্চিত। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ কয়েকটি বড় জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা এখনো দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফারমার্স ব্যাংককে রক্ষায় অনেকটা অযাচিতভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হয়েছে।
বড় জালিয়াতির ঘটনাগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এগুলো নিয়ে সরকারের কাছে জানামতে পর্যাপ্ত তথ্য আছে কিন্তু অগ্রগতি নেই।
বড় বড় লুটপাটের ঘটনায় অর্থনীতি ও উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বিদ্যমান। প্রায় সবাই জানেন অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসা পরিচালনার নামে দেশের তফসিলি ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে আর ফেরত দেননি অনেকে। ব্যাংক খাতের টাকা জনগণের কষ্টার্জিত আমানতের অর্থ। তাই এ খাতের দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই।
ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়াটাই শুধু জালিয়াতি নয়। জামানতের দাম বেশি করে দেখানো কিংবা অনেক দিনের ডরমেন্ট বা বিদেশে থাকা সিনিয়রদের হিসাব থেকে টাকা সরিয়ে ফেলাও জালিয়াতির অন্তর্ভুক্ত। এমনকি প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও অনেক জালিয়াতি হয়েছে বা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির উজ্জ্বল চিত্র আমাদের উল্লসিত করলেও সব উচ্ছ্বাস থেমে যায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির অঙ্ক দেখলে। এ বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সবাই সচেতন ও ওয়াকিবহাল। এমনকি বিষয়টি সবাইকে বিব্রতও করে।
এ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন মহলে এবং ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে দারুণ অস্বস্তি রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া, উচ্চ আদালতে রিট, সর্বোপরি বিচার না হওয়ার কারণেই বড় বড় অর্থ আত্মসাৎ ও ঋণখেলাপির ঘটনা বাড়ছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া অর্থ আত্মসাৎ সম্ভবও নয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়াই এর প্রমাণ।
ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে হলে প্রথমেই আর্থিক খাতে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা ও পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। ইনসাইডার ল্যান্ডিংয়েরও প্রধান কারণ এই পরিচালকেরা।
আগেই বলেছি, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই ব্যাংক ও আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা কমবেশি ঘটে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়াও হয় দ্রুত। কয়েক বছর আগে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই এক গবেষণায় দেখা গেছে, আর্থিক জালিয়াতিতে জড়িত থাকায় ভারতে প্রতি চার ঘণ্টায় অন্তত একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ধরা পড়েন ও দণ্ডিত হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকায় ফিলিপাইন তাদের বিচারকাজ শেষ করে দায়ীদের শাস্তি দিলেও বাংলাদেশে এর কোনো সুরাহাই হয়নি। কাদের উদাসীনতায় এটি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দুদকের লোকবল স্বল্পতা থেকে সক্ষমতার ঘাটতিও দৃশ্যমান। এর সঙ্গে আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকর তো রয়েছেই। বছরের পর বছর মামলার তদন্ত চলে।
তদুপরি মামলাগুলো সঠিকভাবে তদন্ত না হওয়ায় এবং সঠিক তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারায় অপরাধীদের অনেকেই ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আইনি ও দালিলিক ঘাটতি দূর করা আবশ্যক।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুদক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করে দ্রুত মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নিয়েছে। দুদকের আইনজীবীদের মামলার সব তথ্য আইনানুগভাবে আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকেও বিভিন্ন ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করে দুদকে প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। তবে দুদকের তদন্তে গতি আসছে না এবং মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তিও হচ্ছে না। ফলে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, শুধু মামলার ধীর গতি দূর করাই যথেষ্ট নয়, বড় অঙ্কের জালিয়াতি রোধে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিও আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে জাল-জালিয়াতির প্রবণতা কমাতে হলে বড় অঙ্কের ঋণের ওপর তদারকি বাড়াতে হবে।
ঋণ অনুমোদনের শর্ত পূরণ, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের বাজারদর বা মূল্য নির্ণয়ের ব্যাপারেও নজরদারি বাড়াতে হবে। এসব ঋণ যাতে খেলাপি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে দুদক আশাবাদী হলেও মামলাগুলোর অগ্রগতি হতাশাজনক। দুদক আইনে যেকোনো মামলা দায়েরের পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার বিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে বিচার শুরু হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার কথা। কিন্তু দুদকের মামলায় বেশির ভাগই দুই থেকে আড়াই বছর লেগে গেছে তদন্ত শেষ করতে।
একইভাবে বিচার শুরু হওয়ার পরও বছরের পর বছর অতিবাহিত হলেও শেষ হচ্ছে না বিচারকাজ। দুদকে দক্ষ ও নিষ্ঠাবান আইনজীবীর সংকট রয়েছে। ২০০৭-০৮ সালেও আমরা দেখেছি বেশির ভাগ চেনা ও ভালো আইনজীবীই সরকারের তথা দুদকের পক্ষে কাজ করতে অনীহ ছিলেন।
এই কারণে দুদক প্রভাবশালী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েও বেশির ভাগ মামলায় আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছে না। এই কারণে দুদকের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল শক্তিশালী করা এবং মামলার প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ আইনজীবী দ্বারা মামলা পরিচালনার ব্যাপারেও নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও বাণিজ্যিক ব্যাংকের দৈনন্দিন পরিচালনা সম্পৃক্ত অনুমোদনের কাজ থেকে বেরিয়ে কীভাবে সামগ্রিক আর্থিক খাতে জালিয়াতি রোধে আরও কার্যকর হওয়া যায়, সে ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে বোধ হয় ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন রয়েছে।
এমনকি যুক্তরাজ্যসহ অন্য কিছু দেশের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল সুপারভাইজরি এজেন্সিকে আলাদা দুটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা যায় কি না, তা নিয়েও ভেবে দেখা যেতে পারে।
মামুন রশীদ, ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।