আর কত প্রাণ হবে বলিদান?
জীবজগতে মৃত্যু হাহাকারময় ধ্রুব সত্য। এরপরও কোনো তরুণ প্রাণের হুট করে ‘নাই’ হয়ে যাওয়া কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষ করে বাসচালকদের বিবেক-বুদ্ধি গিলে খেয়ে বেপরোয়াভাবে চালানোর পরিণতিতে ঘটা তরুণ প্রাণের অকালমৃত্যু। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম ও একই কলেজের ছাত্রী দিয়া খানমের গা থেকে এখনো কৈশোরের গন্ধ যায়নি। জীবনের দোরগোড়ায় পা রাখার আগেই দপ করে নিভে গেল তাদের জীবনের আলো।
এমন না যে তারা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল। জাবালে নূর পরিবহন লিমিটেডের বাসের চালক বাসটি সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর উঠিয়ে দেন। একই জায়গায় ১ জুলাই বসুমতী পরিবহনের বাসের চাপায় নিহত হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র শাহরিয়ার সৌরভ। ২ জুলাই মিরপুরে দিশারী পরিবহনের বাসের চাপায় নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সৈয়দ মাসুদ রানা। এর আগে গত ১৬ এপ্রিল দুই বাসের রেষারেষিতে হাত বিচ্ছিন্ন হয় তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের। টানা কয়েক দিন আইসিইউতে সংজ্ঞাহীন থেকে তিনি মারা যান। গত ১৭ মে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুই বাসের রেষারেষিতে আহত হওয়ার পর প্রাণ হারান ঢাকা ট্রিবিউনের কর্মকর্তা নাজিমউদ্দীন।
এভাবে একের পর এক প্রাণহানি ঘটছেই। কিন্তু এই দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গত রোববারের ঘটনায় দুই বাসচালক ও দুই সহকারীকে মিরপুর থেকে গতকাল সোমবার গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
রোববার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ভারতের মহারাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২ জন মানুষ মারা গেলেও নাকি কেউ প্রশ্ন করেননি। প্রতিবারই এমন কথা শুনি। ধরে নেওয়া গেল, প্রতিটি অপঘাতেরই সাজা হবে; কিন্তু এমন অপঘাত বন্ধ করার বিষয়ে তাঁদের কি কিছু করার আছে?
মন্ত্রী আরও বলেছেন, দায়ী ব্যক্তিরা অবশ্যই সাজা পাবেন। কিছুতেই রেহাই পাবেন না। আগের ঘটনাগুলোতেও এমন প্রতিশ্রুতি অনেকেই দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে যথাযোগ্য শাস্তির ঘটনা কটি? পত্রপত্রিকায় বারবার খবর প্রকাশিত হয়, সমব্যথীরা রাজপথে নামে, কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি আর হয় না। ঢিমেতালে গড়ানো বিচারপ্রক্রিয়ায় তা আটকে থাকে, নয় তো একপর্যায়ে ঘটনাই হারিয়ে যায় অন্য সব ঘটনার আড়ালে।
এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যানবাহনগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেস জরিপে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ জনস্বার্থে এই রিট করেন। তিনি বলেন, যানবাহনগুলোর লুকিং গ্লাস, ব্রেক লাইট, সিগন্যাল লাইট ঠিক নেই। এমনকি অনেক যানবাহনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেসও নেই। সংবিধান বলছে, আইনগত অধিকার ছাড়া কাউকে জীবন থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। ফিটনেসবিহীন এসব যানবাহনের কারণে যেখানে-সেখানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়।
দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি নিজেই একজন বাসচালক। ঢাকা-রাজশাহী পথে ৩০ বছর ধরে দূরপাল্লার বাস চালাচ্ছেন। বাসচালকদের অনেকের অবহেলা এবং মালিকদের অনেকের দায়িত্বহীনতার কথা তিনি নিজেই বলেছেন। আর বাস না চালানোর কথাও তিনি বলেছেন। তাঁর আয়েই দুই মেয়ে ও এক ছেলে পড়াশোনা করছে। গতকাল তিনি যখন খবর পেলেন, তাঁর মতোই এক বাসচালকের বেপরোয়া আচরণে চিরতরে হারিয়ে গেছে বুকের মানিক, তখন তাঁর কী অনুভূতি হয়েছিল? কুর্মিটোলা হাসপাতালে গিয়ে যখন মেয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ পেলেন, তখন নিশ্চয় তাঁর মাথার ওপর দিগন্তছোঁয়া আসমানটা বিদীর্ণ হয়েছিল। চারদিকে তিনি বিষম নীল ছাড়া আর কিছু কি দেখতে পেয়েছিলেন? যে মেয়েকে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, সে তখন কেবলই আশার সমাধি।
শোকতপ্ত জাহাঙ্গীর সখেদে বলেছেন ভেতরের কথা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বা অন্য প্রভাব খাটিয়ে ঢাকায় একটার পর একটা বাস কোম্পানি তৈরি হচ্ছে। বাসমালিকেরা আত্মীয়-পরিজন যাকে পাচ্ছে, তাকেই স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন। এসব চালকের বেশির ভাগই নেশাগ্রস্ত। কেউ কেউ তো গাড়ি চলন্ত অবস্থায়ও গাঁজা খাচ্ছে। তাদের থামাতে হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি পরিস্থিতি বোঝেন। যেখানে উড়ালসড়কের ঢাল বড় রাস্তায় মিশেছে, আবার সামনে বাঁক আছে, আছে স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল—এসব জায়গায় দক্ষ চালকেরা ধীর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে গাড়ি চালান। কিন্তু দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির চালক এ রকম পরিস্থিতিতেও বেপরোয়া ছিলেন, এখানেই তাঁর অদক্ষতার পরিচয়। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মেরে বাসটি থামাতে হয়েছে তাঁকে।
তবে কি রাজধানীর সড়কগুলো তরুণদের বলি হওয়ার যূপকাষ্ঠ হয়ে উঠেছে? অনেক আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। একবার এক রাজদরবারে বিশাল ফাটল দেখা দিল। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল সেই ফাটল। রাজা তখন রাজজ্যোতিষীর কাছে ধরনা দিলেন। জ্যোতিষী বলল, সবচেয়ে দামি জিনিস ওই গর্তে না ফেললে ওটা বুজবে না। রাজার হুকুমে প্রজারা একে একে ওতে নিজ নিজ মূল্যবান জিনিস ফেলতে লাগল। কিন্তু ফাটল আর বোজে না। বরং তা বিশাল খাদে পরিণত হলো। এবার রাজপ্রাসাদ যায় যায়। শেষে এক টগবগে তরুণ এল ঘোড়ায় চড়ে। বলল, জীবনের চেয়ে দামি আর কিছু নেই। এই বলে ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে পড়ল ওই খাদে। তরুণ প্রাণের বিনিময়ে ধীরে ধীরে বুজে গেল ওই গর্ত।
তবে তরতাজা কচি প্রাণ উৎসর্গ করে কোন যজ্ঞ চালানো হচ্ছে? লোভের, ক্ষমতার, দলীয়পনার? আর কত প্রাণ ঝরলে শেষ হবে এই যজ্ঞ?
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]