মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল বানচালের জন্য ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প-সমর্থকদের যে তাণ্ডব, সে ঘটনার বর্ষপূর্তি হয়ে গেল। ওই ঘটনা তদন্তে এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের সহিংসতার পুনরাবৃত্তি না হয়, তা ঠেকাতে আইনসভার যে তদন্ত কমিটি (জানুয়ারি ৬ কমিটি) গঠন করা হয়েছে, কাকতালীয়ভাবে তাদের কার্যক্রমও নতুন ও নাটকীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তদন্ত কমিটিটি আইনসভার সাত সদস্য নিয়ে গঠিত। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ডেমোক্র্যাট ও দুজন রিপাবলিকান (বেশির ভাগ রিপাবলিকান সদস্য তদন্তের বিরোধিতা করেছেন) সদস্য রয়েছেন। ক্যাপিটল হিলে হামলার বর্ষপূর্তিতে তাঁরা বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন। বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই যে ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীরা তদন্ত কমিটির এ কার্যক্রম প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছেন। এ বছরের নভেম্বরে যে মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে, তাতে রিপাবলিকানরা জয়ী হলে তাঁরা তদন্ত কমিটির কার্যক্রম মাঝপথেই বন্ধ করে দেবেন।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তদন্ত কমিটির প্রধান বেনি থমসন বলেছেন, যদি প্রয়োজন হয়, তবে তাঁরা তদন্তের পরিসর ছোট করে আনবেন। মধ্যবর্তী ভোটের আগে তাঁরা সেটা করতে চান। তবে এত অল্প সময়ে সেটা সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য জেমি রাস্কিন সম্প্রতি আমাকে বলেছেন, ‘প্রতিবেদন যাতে তথ্যভিত্তিক, শিক্ষামূলক ও আইনগত হয়, তদন্ত কমিটি সে উদ্দেশ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের একটি সমন্বিত ও স্বচ্ছ প্রতিবেদন প্রকাশ করা প্রয়োজন, যাতে আমেরিকার গণতন্ত্র সুরক্ষিত রাখার জন্য সুপারিশ আমরা করতে পারি।’
জেমি রাস্কিনের এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, তদন্ত কমিটি ৯/১১ কমিশনের মতো একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে চাইছে। ৯/১১ ও ৬/১ দুটি ঘটনাতেই আরও অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। দুটি ঘটনাই পুরো জাতিকে হতবাক করে দিয়েছিল। আবার দুটি ক্ষেত্রেই গোয়েন্দারা আগে থেকেই সতর্ক করেছিলেন, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু সে সতর্কতা আমলে নেওয়া হয়নি। তদন্ত ঘিরে যে প্রশ্ন এখন জনমনে তৈরি হয়েছে, সেটি হলো শুধু কি সহিংসতাকারীরা বিচারের মুখে পড়বেন? ট্রাম্পের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁরা সহিংসতায় অংশ নিয়েছিলেন। হামলাকারীরা যদি শাস্তির মুখে পড়েন, তাহলে প্ররোচনাকারী কেন বাদ যাবেন?
২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল বানচালচেষ্টার সঙ্গে উচ্চপদস্থ যাঁরা মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড জোরালো কোনো ব্যবস্থা না নিতে পারায় সমালোচিত হয়েছেন। এটা স্পষ্ট যে জো বাইডেন ২০২০ সালের তাঁর নির্বাচনী প্রতিপক্ষ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক। এমনকি তাঁরা দুজন যদি ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না–ও করেন, তারপরও পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর সমর্থকদের বিচারের মুখোমুখি করার যেকোনো প্রচেষ্টা বাইডেন সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এমনকি গত বছরের চেয়েও বড় সহিংসতার ঝুঁকি তৈরি হবে।
প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহিংসতা যুক্তরাষ্ট্রে একটা উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকানদের মধ্যে, বিশেষ করে রিপাবলিকানদের মধ্যে অনেকে মনে করেন, সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায্য। সিবিএস নিউজের ইউগভ জরিপে হতাশাজনক একটি চিত্র উঠে এসেছে। ৬২ শতাংশ জরিপকারী মনে করেন, নির্বাচনে হারলে সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখানো যায়। সহিংসতার অনেক পুরোনো ইতিহাস রয়েছে আমেরিকায়। পশ্চিমে বসতি স্থাপন কিংবা দাসপ্রথাসহ অন্যান্য সহিংসতার বহু নজির রয়েছে সেখানে। সংবিধানিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রেও সহিংসতার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ২০০০ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশ ও আল গোরের সমর্থকদের মধ্যে যে বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছিল, সেখান থেকেই সর্বশেষ নির্বাচনে যে সহিংসতা, তার উদ্ভব। ‘২০২০ ও ২০২১ সালে আমরা আমাদের গণতন্ত্র হারানোর কত কাছে চলে এসেছি’—এমন আক্ষেপ এখন অনেকের কাছ থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমি এ ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। কেননা, নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের যে প্রচেষ্টা, সেটা ছিল খেলো ও বোকামিতে ভরা। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছয়টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে তিনটির ফলাফল পাল্টে দেওয়া ট্রাম্পের জন্য ভয়ংকর চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বৈধ যে ফলাফল, সেটা ছুড়ে ফেলা আমেরিকার ঐতিহ্যের গভীর পরিপন্থী ব্যাপার। ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, অনেক রাজ্যে ভোটে কারচুপি হয়েছে। সেসব রাজ্য আদালত ও কেন্দ্রীয় আদালত তাঁর এই দাবি নাকচও করে দিয়েছেন।
মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানরা হয়তো জিতে জেতে পারেন; রাজ্য আইনসভায় জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে রিপাবলিকানরা ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে বেশি চতুর। সে ক্ষেত্রে আমেরিকার গণতন্ত্রকে নিরাপদ রাখার জন্য ‘জানুয়ারি ৬ কমিটি’র কার্যক্রম ঝুলে যাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● এলিজাবেথ ড্রু ওয়াশিংটনভিত্তিক সাংবাদিক ও লেখক