কাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে পারে, বাছাই কমিটির এমন উদ্যোগে ৩২২ জনের নাম জমা পড়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে নিজ উদ্যোগেও এসব নাম জমা দিয়েছেন। কারা কোন নাম জমা দিয়েছেন, তা অবশ্য জানার উপায় নেই। কারণ, বাছাই কমিটির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, কে কোন নাম দিয়েছে, তা প্রকাশ করা হবে না। তালিকা প্রকাশের পর আমাদের বন্ধু সাংবাদিক জায়েদুল আহসান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজেবাজে নামগুলো কারা দিল, সেটা জানা দরকার। দল, সংগঠন বা ব্যক্তির রুচিবোধটা জানা যেত!’
জায়েদুল আহসান ও আমাদের মতো অনেকের ‘রুচিবোধ’ জানার এ আকাঙ্ক্ষা হতাশাজনকভাবে কোনো দিনই পূরণ হবে না।
৩২২ জনের তালিকায় থাকা ‘আজেবাজে’ নামগুলো অনেক বিশিষ্টজনকে ক্ষুব্ধ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। এ তালিকায় যে আমলাদের আধিক্য রয়েছে, সেটা আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি। মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও আমাদের প্রথম আলোর কলাম লেখক। তাঁর একজন সাবেক সহকর্মীর নাম এসেছে এ তালিকায় এবং তিনি তাঁকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছেন। তাঁর সেই ফোনালাপের অভিজ্ঞতা তিনি শেয়ার করেছেন তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে—
‘নির্বাচন কমিশনে পদের জন্য তালিকাভুক্ত হওয়ায় একজন সাবেক সহকর্মীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। জবাবে তিনি বললেন, “স্যার, আমার নাম আসায় আমি বিব্রত।” এমনটিই দাঁড়িয়েছে নির্বাচন কমিশনের হাল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যেকোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিকই এ দায়িত্ব পালনে অপারগতা জ্ঞাপন করবেন। অথচ, সাংবিধানিক এ পদে কাজ করার সুযোগ যেকোনো নাগরিকের জন্য গৌরবের বিষয় হওয়ার কথা ছিল। কে এ প্রশ্নের জবাব দেবে?’
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে ওই সচিবের নাম যিনি বা যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা ওই সচিবের কাছ থেকে সম্মতি নেননি। তিনি সম্মতি দিলে নিশ্চয়ই তালিকায় নিজের নাম দেখে বিব্রত হতেন না। তাঁর নাম দিয়ে যে বা যাঁরা তাঁকে ‘বিব্রত’ করলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কী? তালিকায় নাম থাকা এই সচিব কেন বিব্রত হয়েছেন, তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে ওই সচিবের নাম যিনি বা যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা ওই সচিবের কাছ থেকে সম্মতি নেননি। তিনি সম্মতি দিলে নিশ্চয়ই তালিকায় নিজের নাম দেখে বিব্রত হতেন না। তাঁর নাম দিয়ে যে বা যাঁরা তাঁকে ‘বিব্রত’ করলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কী? তালিকায় নাম থাকা এই সচিব কেন বিব্রত হয়েছেন, তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না। এ বাছাই কমিটিতে সব রাজনৈতিক দল তাদের নাম দেয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের স্পষ্ট অনাস্থা রয়েছে এ কমিটির প্রতি। ফলে এখান থেকে যাঁদেরই বাছাই করা হোক না কেন, গ্রহণযোগ্যতার একটি সংকট থেকেই যাবে। নিজের সুনাম বা সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা হারানোর ভয়টিও এখানে কাজ করে থাকতে পারে।
আসলে নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড, আগের দুই দফা নির্বাচন কমিশন নিয়োগপ্রক্রিয়া—সব কটি বিষয় এ মাত্রায় বিতর্কিত ও আস্থার সংকটে পড়েছে, যে তালিকায় নাম থাকলে একজন নাগরিক হিসেবে কারও গর্বিত হওয়ার কথা, তা না হয়ে তিনি উল্টো বিব্রত হচ্ছেন।
এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির পুরো দায় না হলেও সবচেয়ে বড় দায় যার, সেই বিদায়ী নির্বাচন কমিশন এবং এর প্রধান কমিশনার অবশ্য এসব নিয়ে একেবারেই বিব্রত নন। শেষ কর্মদিবসে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছেন, তাঁদের পাঁচ বছরে সফলতার পাশাপাশি কিছু ব্যর্থতাও আছে। কোনো কোনো দলের আস্থা তাঁরা অর্জন করতে পারেননি। তাঁদের পাঁচ বছরের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে ‘মোটেও বিব্রত নন’ তিনি।
‘রাতের ভোট’, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস’, ‘জাতীয় নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ’—এসব বিষয় যে নির্বাচন কমিশন ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তিনি যদি বিব্রত না হন, তবে তাঁকে জোর করে ‘বিব্রত’ করাবে কে?
একটি বাগধারা মনে পড়ে গেল—যার এক কান কাটা, সে রাস্তার এক পাশ দিয়া হাঁটে, যার দুই কান কাটা, সে হাঁটে হাটের মাঝখান দিয়ে। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক কি না, পাঠক বিবেচনা করে দেখুন।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক