ভোটে হারজিত ও প্রেমে হারজিতের প্রকৃতিগত ফারাক বিস্তর। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কেউ কাঁদেন, এমনকি হতাশায় আজীবন কুমার বা কুমারী থাকেন, কিংবা আত্মহননের পথও বেছে নেন। কিন্তু নির্বাচনে হেরে পৃথিবীর দেশে দেশে সম্মানজনকভাবে হার মেনে নেওয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি থাকলেও আমাদের দেশে হার মেনে নেওয়া হয় না। হার না মানার একটা অন্যতম কারণ, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় নিরপেক্ষতা, আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার অভাব। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হারজিতের ঘটনা একদিন কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও মান্না দের অমর গানের (‘কী তার জবাব দেবে’) সুরটি কানে বাজতে থাকবে এবং অবিরাম কিছু প্রশ্নের ‘জবাব’ চেয়ে যাবে। ‘আমি কি হেরেছি, তুমিও কি একটুও হারোনি?’
কেউ হয়তো জবাব দেবে না। আমাদের ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ সিস্টেমে পাঁচ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে যিনি এক ভোটেও এগিয়ে থাকবেন, তিনিই আইনত জয়ী। এ নিয়মে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে জয় পেয়েছেন। ৫০ হাজার ৩১০ (৩৭.২৪%) ভোটে জয় নিশ্চিত হলো। কিন্তু সম্মিলিতভাবে অন্য চার প্রার্থী মিলে বিজয়ী প্রার্থীর বিপরীতে ৮৪ হাজার ৪৩৫ অর্থাৎ ৬২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের হার হয়েছে নির্বাচন পদ্ধতির কাছে। দ্বিতীয় একটি প্রশ্নেরও ‘জবাব’ দরকার, ৩১৯ ভোট ইভিএমে নষ্ট হয় কীভাবে? তৃতীয় প্রশ্নের জবাব চাইব, নেউড়া এম আই হাইস্কুল কেন্দ্রের ভোটারদের অভিযোগ ছিল, তাঁদের ইভিএমের স্ক্রিনে শুধু ‘নৌকা’ প্রতীক ভেসে ওঠে, অন্য প্রতীকগুলো আসছে না। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য কর্তব্যরত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক ওই কেন্দ্রে গেলে প্রিসাইডিং অফিসার নাজমুল আমিন হাকিম সাহেবকে বুথে ইভিএম পরীক্ষা করতে বাধা দেন (স্টার ডিজিটাল রিপোর্ট, জুন ১৫)। এ বাধা দেওয়ার রহস্য কী? পরের প্রশ্নও ইভিএম–সম্পর্কিত।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একই দিনে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক ইউনিয়নেও ভোট হয়। ওই নির্বাচনে ২ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুই সদস্য পদপ্রার্থী যথাক্রমে আমীনুল ইসলাম ও মোশারফ হোসেনকে নিজ নিজ কেন্দ্রের ঘোষিত ফলাফলে ৫৮ ও ২৪২ ভোটের ব্যবধানে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস থেকে রাতে ফলাফল পরিবর্তন করে অন্য দুজনকে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা সংক্ষুব্ধ প্রার্থীদের বিষয়টির কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পরামর্শ দেন (প্রথম আলো, ১৭ জুন ২০২২)। ইভিএম সম্পর্কে আরও অনেক সাধারণ প্রশ্ন ছিল। তার একটি সাধারণ প্রশ্ন ছিল ভোট গ্রহণে ধীরগতি, অনেকের শনাক্তকরণে সমস্যা ও ভোটারের ভোট না দিয়ে ফিরে যাওয়া। কুমিল্লার হোচ্ছামিয়া হাইস্কুল কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে প্রথম ৯০ মিনিটে ভোট সংগৃহীত হয় ৩২টি। প্রতি ভোটপিছু গড়ে তিন মিনিট সময় ব্যয় হয় (আহসান হিমেল, চ্যানেল ২৪)। সে হিসাবে সারা দিনের ৮ ঘণ্টায় একটি বুথে ১৬০–এর বেশি ভোট গ্রহণ সম্ভব হবে না। সাধারণত একটি বুথে ৩০০ থেকে ৪০০ ভোট থাকে।
নির্বাচনের কয় দিন আগে থেকে স্থানীয় জাতীয় সংসদ সদস্যের আচরণবিধি লঙ্ঘনও একটি বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ভোটের দিন তিনি প্রকাশ্যে ইসিকে দোষারোপ করেন। জনৈক ইসি সদস্যের ভাষায় সেটি ‘ইজ্জতের সওয়াল’ হয়ে যায়। ইজ্জত–বেইজ্জত কার, সেটি পরিষ্কার হয়নি। শেষ প্রশ্নটি করা যায়, ভোটের ফলাফল ঘোষণার সময়কালে কুমিল্লার শিল্পকলা একাডেমির বাইরে স্থানীয় জাতীয় সংসদ সদস্য যখন অবস্থান করছিলেন এবং কর্মী-সমর্থকেরা স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখনো নিশ্চয়ই ‘নির্বাচনী আচরণবিধি’ বলবৎ ছিল। রাত ৮টা ৪৫ মিনিট থেকে ৯টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময়ের নানা নাটকীয়তায় ঘোষিত ফলাফল জনমনে নানা সন্দেহ সৃষ্টি করে। প্রথমত, ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফল একজন এগিয়ে থেকে পরের চারটি কেন্দ্রের সমন্বিত ফলাফলে পরাজিত হয়ে যাওয়া এবং মাঝখানে রিটার্নিং কর্মকর্তার আসন ত্যাগ, ফোনালাপ, নির্বাচন ফলাফল ঘোষণাকক্ষে মিছিলের প্রবেশ, পাল্টাপাল্টি স্লোগান, হাতাহাতি, কক্ষের বাইরে এলাকার জাতীয় সংসদ সদস্যের অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এখনো ইসির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অথচ ফলাফল ঘোষণা করে সবাই বাড়ি ফিরে গেছেন।
আবারও মান্না দের গানের কথায় ফিরে এলে, এ নির্বাচনে বোধ হয় সবাই হেরেছে। ইসিকে তার জয়-পরাজয়ের নিজের মূল্যায়ন জাতিকে জানাতে অনুরোধ করি। মাঝখানে যদি কেউ আদালতে যান, সে বিষয়টি আগামীর জন্য ঝুলে থাকল।
এ প্রশ্নগুলোর জবাব কে দেবেন? ইসিকেই এ প্রশ্নগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে হবে। তাই এ নির্বাচনে ১ জন মেয়র, ২৭ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৯ জন সংরক্ষিত আসনের নারী জিতে এলেন। অন্য প্রার্থীরা ভোটের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক নিয়মে হারলেন। সেটি এ ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ইসি দক্ষতা, যোগ্যতা, নিরপেক্ষতা, সব প্রার্থীর সমতল ভূমি সুরক্ষা প্রভৃতির ক্ষেত্রে কতটুকু সফলতা দেখাতে পারল। ইভিএম নিয়ে সরকারের অতি আগ্রহ। এ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর ও আশাপ্রদ নয়। ওপরে উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর খুঁজলে, তা অনায়াসে বোঝা সম্ভব।
সর্বশেষ দুটি প্রশ্নের অবতারণা করে এ লেখা শেষ করব। এক. যে চার কেন্দ্রের ফলাফল বিলম্বে ঘোষিত হলো, সে চারটি কেন্দ্রে কি প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়ম অনুযায়ী ফলাফলের প্রিন্ট কপি এজেন্টদের দিয়েছেন, কেন্দ্রে ফলাফল টাঙানো হয়েছিল এবং ইসিকে একটি কপি পাঠানো হয়েছিল? কর্তব্যরত সাংবাদিকদের কারও কাছে কি ওই কেন্দ্রগুলোর বেসরকারিভাবে কেন্দ্রে ঘোষিত ফলাফল আছে বা ছিল? থাকলে এগুলো মিলিয়ে দেখলে মিল-গরমিল খুঁজে পাওয়া যেত। দুই. এখন যদি পরাজিত মেয়র প্রার্থী আদালতে যান এবং ওই চার কেন্দ্রের ফলাফল পুনর্গণনা এবং বিনষ্ট ৩১৯ ভোটের প্রকৃত অবস্থা জানার দাবি করেন এবং এ বিষয়ে আদালতের রুলিং চান, তাহলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় আদালত পুনর্গণনার বিষয়, রিটার্নিং কর্মকর্তার আসন ত্যাগ, ফোনালাপ, পূর্বে জাতীয় সংসদ সদস্যের আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং সর্বশেষ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাননীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিও আচরণবিধি ভঙ্গের পর্যায়ে পড়ে কি না, তা বিবেচনা করবেন। এ মামলা যদি করা হয়, এ মামলার রায়ে ইভিএম নিয়েও আদালতের নির্দেশনা বা পর্যবেক্ষণ আশা করা যায়।
আবারও মান্না দের গানের কথায় ফিরে এলে, এ নির্বাচনে বোধ হয় সবাই হেরেছে। ইসিকে তার জয়-পরাজয়ের নিজের মূল্যায়ন জাতিকে জানাতে অনুরোধ করি। মাঝখানে যদি কেউ আদালতে যান, সে বিষয়টি আগামীর জন্য ঝুলে থাকল।
● তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ, স্থানীয় শাসনবিষয়ক গবেষক ও লেখক