আমার সিরীয় বন্ধু ফুয়াদের কথা লিখেছি আগে। ডাক্তার এবং কবি। বিশ্বস্বাস্থ্যের এক গবেষণা প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে পরিচয়। আমরা সমবয়সী, দুজনেই ডাক্তারি পড়েছি; কিন্তু নেশা সাহিত্যে। ফলে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে দ্রুত। সিরিয়ার আলেপ্পোতে তার বাড়িতে, ক্যাফেতে আড্ডা হয়েছে বহুবার। তার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক হয়েছিল। কারণ, সে আমার লেখা হাসপাতালের ওপর নৃবৈজ্ঞানিক বইটা ইংরেজি থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ শুরু করেছিল। আলেপ্পোর পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেই বইটার খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলেছি। সেই আলেপ্পো এখন এক মৃত নগর। ফুয়াদ এখন উদ্বাস্তু লেবাননের বৈরুতে।
তার সঙ্গে দেখা হলো বহুদিন পর বৈরুতেই। সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর এই আমাদের দেখা। টগবগে, ফুর্তিবাজ ফুয়াদ এখন বিমর্ষ। আলেপ্পোর এক জনস্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থার দায়িত্বে ছিল ফুয়াদ। আলেপ্পো শহরে যখন তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা, তখন ফুয়াদ বাড়ি বদলের আয়োজন করছিল। ফুয়াদ তার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে আলেপ্পো শহরের প্রান্তে তার মনের মতো একটা বাড়ি কিনেছিল। তার রূপসী স্ত্রী রাবেয়া, যে একজন প্রকৌশলী। আমাকে সে বাড়ির ছবি দেখিয়ে বলছিল, কী করে সেই বাড়িটা সাজাবে সে। তারপর
তাদের সেই স্বপ্নের বাড়িতে ওঠার ঠিক এক বছরের মাথায় শুরু হয়ে গেল সিরিয়ার স্মরণাতীত কালের এই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ।
হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে চলতে হলো তাদের। একদিন বোমায় বিধ্বস্ত হয়ে গেল ফুয়াদের অফিস। এই মৃত্যুপুরী থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল তারা। কিন্তু বেরোনোর পথ রুদ্ধ।
ভাসমান রাবারের নৌকায় শত শত সিরীয় শরণার্থীকে যেভাবে বিপজ্জনকভাবে সাগর পাড়ি দিতে দেখি আমরা টিভির পর্দায়, সে পথেই দেশান্তরী হওয়ার কথা ভাবছিল ফুয়াদ। এ সময় তাকে কেউ একজন সন্ধান দেয় গোপন এক স্থলপথে লেবাননে পালিয়ে যাওয়ার। বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে একটা বিশেষ গাড়িতে স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে ফুয়াদ এক রুদ্ধশ্বাস যাত্রায় সিরিয়া সীমান্ত পাড়ি দেয়। যে পথ দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে, তার একদিকে আসাদ বাহিনী, অন্যদিকে বিদ্রোহী সেনাবাহিনী। দুই পক্ষের গোলগুলির মধ্যে পড়ার সমূহ বিপদের ভেতর প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা পৌঁছায় বৈরুতে।
ফুয়াদ সৌভাগ্যবান যে তাকে উদ্বাস্তু শিবিরে যেতে হয়নি। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের কিছু অধ্যাপকের সঙ্গে তার চেনা-জানার সূত্র ধরে সেখানে একটা গবেষণার কাজ জুটেছে। তার প্রকৌশলী স্ত্রী কোনো কাজ পায়নি। লেবাননে সিরীয় নাগরিকদের কাজের রয়েছে নানা বাধা। ফুয়াদকে শুধু বছর দুয়েকের জন্য কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এরপর কী হবে সে জানে না। তখন তার পাসপোর্টের মেয়াদও যাবে শেষ হয়ে। সে কোথায় যাবে তার ঠিক নেই। নিজের সদ্য কেনা বাড়ি ফাঁকা ফেলে বৈরুতের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া করে পরিবার নিয়ে উঠেছে ফুয়াদ।
ফুয়াদ এসব কথা যখন আমাকে জানাচ্ছে, তখন আলেপ্পোতে তার সঙ্গে কাটানো একটা দিনের কথা মনে পড়ে আমার। আমাকে আর তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে গাড়িতে করে বেরোল ফুয়াদ। মেয়েকে নামাল সুইমিং লেসনে, মনে পড়ে লাল আর সাদার এক চমৎকার জামা পরা তার কিশোরী মেয়ে সুইমিং পুলে যেতে যেতে হাত নাড়িয়ে বিদায় নিল ফুয়াদের কাছে, এরপর সে তার ১০ বছরের ছেলেকে নামাল পিয়ানো স্কুলে। বলল, তার স্ত্রী রারেয়া এসে তুলে নিয়ে যাবে এদের। তারপর আমাকে নিয়ে চলল আলেপ্পোর কেন্দ্রে এক আর্ট সেন্টারে। সেখানে আমরা একটা আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন দেখলাম। এক্সিবিশন দেখা শেষে সেখানকার ক্যাফেতে বসে কফি খেতে খেতে আমি আর ফুয়াদ আলাপ করলাম আরব আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে। আরব কবি এডোনিস নোবেল পুরস্কার পাবেন—এমন কথা উঠেছিল সেবার। এডোনিসের কবিতা নিয়ে কথা হলো ফুয়াদের সঙ্গে।
সন্ধ্যা নামলে ওই আর্ট সেন্টারের মাঝখানের খোলা চত্বরে এরপর শুরু হলো এক সংগীতের আসর। এক সিরীয় শিল্পী বিখ্যাত আরব গায়িকা ফাইরুজের গানগুলো গাইলেন। চমৎকার ফুরফুরে বাতাসে বসে অনেকে শুনলাম সেই গান। তারপর ফুয়াদের বাড়িতে ফিরে এসে হলো রাতের খাওয়া। তার স্ত্রী রাবেয়া ফাটুস সালাদ, নানা রকম মেজে, হামুস আর চমৎকার সিরীয় রুটি দিয়ে পরিবেশন করল খাবার। ভাবছিলাম, এমন একটা নির্ঝঞ্ঝাট, আটপৌরে মিষ্টি দিন এখন ফুয়াদের দূর কল্পনারও অতীত। আলেপ্পোর সেই সব পথ, সুইমিং পুল, আর্ট সেন্টার এখন ধ্বংসস্তূপ। কত লাখ লোক মারা গেছে এই কয়েক বছরে, কত লাখ লোক দেশান্তরী হয়েছে, সে হিসাব আর রাখে না ফুয়াদ। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সিরিয়া সম্পূর্ণ এক অচেনা দেশ এখন ফুয়াদের কাছে।
ফুয়াদ বলছিল, আসলে দেশ বলতে কী বোঝায় তা-ই এখন ধোঁয়াশা হয়ে গেছে তার কাছে। আমরা বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’ ধারণাটা নিয়ে কথা বলি। একটা সময় দেশ বলে তো কোনো ব্যাপার ছিল না। গোত্র ছিল, গ্রাম ছিল কিন্তু দেশ ছিল না। চিনি না, কখনো দেখা–সাক্ষাৎ হয়নি তেমন মানুষদের নিয়ে একটা দেশের ধারণা কয়েক শতাব্দী পুরোনো মাত্র। অ্যান্ডারসন দেখিয়েছেন কী করে ম্যাপ, প্রিন্ট মিডিয়া, ব্যাকরণ বই, মিউজিয়াম, উপন্যাস ইত্যাদি জন্মের সঙ্গে দেশ ধারণার একটা সম্পর্ক রয়েছে। কী করে নানা প্রক্রিয়ায় কোনো বিশেষ ভাষাভাষীর, সংস্কৃতির বা ভৌগোলিক সীমার মানুষের ভেতর কল্পনায় একটা ঐক্যের বোধ তৈরি হয়েছে। দেশ ব্যাপারটার সঙ্গে তাই কল্পনার একটা সম্পর্ক আছে। অ্যান্ডারসন একে বলেছেন ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’। কোনো একটা বিশেষ ঐক্যের সূত্রে, একটা বিশেষ জনগোষ্ঠী কল্পনায় নিজেদের একটা বিশেষ দেশের অধিবাসী মনে করে।
বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা কাল্পনিক নয়, কল্পনার। অ্যান্ডারসন ‘ইমাজিন’ বলেছেন ‘ইমাজিনারি’ বলেননি। ফুয়াদ বলছিল, কিন্তু সিরিয়ার মানুষের কল্পনার সে দেশটি অনেক আগে থেকেই বিভক্ত হতে শুরু করেছিল, ভেঙে পড়েছিল সেই ঐক্য। বাশার আল আসাদ আর তাঁর সরকারের কল্পনার সিরিয়া ছিল এমন এক দেশ, যা চলবে তাঁরই পরিজন, তাঁরই অনুগত ব্যক্তিদের কর্তৃত্বে, অথচ দেশের ভেতর ছিল বহু মানুষ, যাদের কল্পনার সিরিয়া এমন এক দেশ, যা হবে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন। আবার পাশাপাশি সিরিয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল এমনও এক জনগোষ্ঠী, যাদের কল্পনার সিরিয়া হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মভিত্তিক একটা সাম্প্রদায়িক দেশ।
ফুয়াদ বলছিল, আসাদ ভেবেছিলেন সব দিক সামাল দিয়ে সিরিয়াকে তিনি তাঁর কল্পনার দেশেই পরিণত করবেন। কিন্তু আরব বসন্তের ঢেউয়ে চিড় ধরল তাঁর সেই সংকল্পে। মাথা চাড়া দিল অন্য কল্পনার সিরিয়াও। যাঁদের কল্পনায় ছিল একটা গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সিরিয়া, তাঁরা আরব বসন্তের সুবাদে আসাদ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে আসাদ তাঁদের কঠোর হাতে দমন করলেন। তাঁদের দমন করা সহজ হলো। কারণ সেই গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ভিত ছিল দুর্বল, জনগণের ভেতর তাঁদের কর্মকাণ্ড
ছিল সীমিত। পক্ষান্তরে যাঁদের কল্পনায় ছিল সাম্প্রদায়িক সিরিয়া, তাঁরা সিরিয়ার জনগোষ্ঠীর ভেতর আড়ালে শক্ত ভিত তৈরি করেছেন অনেক দিন ধরে। তাঁরা আর্থিক মদদ পেয়েছেন আরব বিশ্বের বিশেষ কিছু দেশ থেকে, একপর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি চক্রও। ফলে এই গোষ্ঠীকে ঠেকানো আসাদের পক্ষে হয়ে উঠল কঠিন।
গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক নানা শক্তিকে বাগে আনতে পারলেও আসাদ হিমশিম খাচ্ছেন উগ্র এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবিলা করতে। ফুয়াদ আরও বলে, যেহেতু আমরা সিরিয়ানরাই আর একই রকম সিরিয়া কল্পনা করি না, যেহেতু আমরা নিজেদের ভেতরই বিভক্ত হয়ে গেছি, ফলে আমাদের এই দুর্বলতার সুযোগে এরপর যার যার মতো ফায়দা লোটার জন্য সিরিয়ায় হাজির হয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব। সিরিয়া এখন আর আমাদের নেই, এর ভবিষ্যৎও এখন আমাদের হাতে নেই। নিজের দেশ হাত ফসকে গেছে আমাদের।
ফুয়াদের কথা শুনতে শুনতে বাংলাদেশের কথা ভাবি। ভাবি এ দেশের সবার কল্পনার দেশটি কি একই রকম আছে, যেমন ছিল স্বাধীনতার ঊষালগ্নে? নাকি বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মনোজগতে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কল্পনার বাংলাদেশ? যদি ধীরে ধীরে কল্পনাই বিভক্ত হয়ে থাকে, তবে এই বিভক্তিকে কি সামাল দেওয়া যাবে? যদি সামাল দেওয়া না যায়, তাহলে এ দেশও কি শেষে পরিণত হবে অন্যের ফায়দা লোটার ভূমিতে? কথা বলতে বলতে ফুয়াদের স্ত্রী রাবেয়া এসে হাজির হয়। আমি চিনতে পারি না তাকে। সেই আত্মবিশ্বাসী, রূপসী প্রকৌশলী এই কটা বছরে কেমন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। রাবেয়া ম্লান হেসে কুশল জানতে চায় আমার। তারপর চা দেওয়ার নাম করে চলে যায় ভেতরে। স্ত্রী চা আনতে গেলে ফুয়াদ আমাকে বলে, রাবেয়া বৈরুতের এই ফ্ল্যাটে এখনো প্রতি রাতে তার বালিশের নিচে আলেপ্পোতে ফেলে আসা তাদের নতুন বাড়ির চাবিটা রেখে ঘুমায়।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
[email protected]