নিউইয়র্ক টাইমস-এর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক সংখ্যায় সাংবাদিক জোডি রোজেন লিখেছিলেন, ‘অন্যান্য শহরের রাস্তায় থাকে গাড়ি এবং পথচারীরা, কখনো রাস্তাগুলো আটকে গেলে পথচলা বাধাগ্রস্ত হয়। ঢাকার পরিস্থিতি ভিন্ন। ঢাকার ট্রাফিক হচ্ছে চরম। এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এত ব্যাপক ও স্থায়ী যে এটা নগরীর গঠন সূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ জোডি আরও লিখেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের অন্যান্য মেগাসিটির মতো একটা উঠতি আবাসন খাত, বেড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণি, একটা প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল নিয়ে ঢাকা যেন যুগপৎভাবে দ্রুত বেড়ে ওঠা এক নগরী ও গোরস্থান, যা অবাধ দুর্গতি: দারিদ্র্য, দূষণ, রোগব্যাধি, রাজনৈতিক দুর্নীতি, চরমপন্থী সহিংসতা, জঙ্গি হামলা ইত্যাদির কারণে পর্যুদস্ত। কিন্তু শিক্ষাবিদ এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের কাছে একুশ শতকের নাগরিক অকার্যকারিতার বিশাল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্বের চরম বিধ্বস্ত শহর ঢাকার পরিচিতি দিয়েছে তার ট্রাফিক। এটি ঢাকাকে পরিণত করেছে একাধারে উন্মত্ত ও স্থবির এক নগরে, পরাবাস্তব একটি জায়গায় এবং বদলে দিয়েছে পৌনে দুই কোটিরও বেশি নাগরিকের জীবনের ছন্দকে।’ ‘ঢাকার ট্রাফিক কেবল একটা বিড়ম্বনাই নয়, এটি দারিদ্র্য, এটি অন্যায়, এটি দুর্ভোগ।’
বিদেশি সাংবাদিকের এই পর্যবেক্ষণের কোনো অংশকেই আমরা অস্বীকার করতে পারব না। ঢাকার যান চলাচলের এই অচলাবস্থা, চালক ও পথচারীদের সৃষ্ট নজিরবিহীন নৈরাজ্য এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহায়ত্ব ও উদাসীনতার ফলে উদ্ভূত অর্থনৈতিক লোকসানের হিসাব এই সাংবাদিক না দিলেও সেটি একাধিক গবেষণায় বের হয়ে এসেছে, যার পরিমাণ ভয়াবহ। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কেবল একটি রুটে (এয়ারপোর্ট-পোস্তগোলা) যানজটের কারণে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। এই ক্ষতির মধ্যে ২০৪ কোটি টাকা যায় সময়ের অপচয়ের কারণে এবং ২৩ কোটি টাকা যায় গাড়ির বাড়তি তেল পোড়ার জন্য।
জাইকার সঙ্গে পরিচালিত অন্য এক সরকারি সমীক্ষায় দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার ট্রাফিক অব্যবস্থার কারণে আমাদের অর্থনীতির বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা এবং দৈনিক সময় অপচয় হয় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। এসব বিমূর্ত হিসাব ছাড়াও দৃশ্যমান যে লক্ষণ দিয়ে ঢাকার দুর্বিষহ ট্রাফিক ব্যবস্থার মূল্যায়ন করা যায়, সেটি হচ্ছে অফিস শুরু এবং ছুটির সময় (পিক আওয়ার) আমাদের গড় গতি। ১৯৯৭ সালে এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার, ২০০৪ সালে ১৬, ২০১০ সালে ১২, ২০১৬-তে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটারে। একটি নিম্নমধ্য আয়ের দেশের রাজধানীর জন্য অবিশ্বাস্যই বটে।
যানজটের কারণে অপচয়িত সময়ের মূল্য বের করা কঠিন। সবার কর্মঘণ্টার মূল্যও সমান হয় না। একজন ছাত্রের কর্মঘণ্টা, একজন ব্যবসায়ী এবং একজন ব্যাংক নির্বাহীর কর্মঘণ্টা সমমানের হবে না। তা ছাড়া ভুক্তভোগীরা তাঁদের অপচয়িত সময়ের মূল্যের ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন নন। যানজট নগরবাসীর জীবন থেকে যে কেবল মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে তা-ই নয়, তাদের জন্য সৃষ্টি করেছে স্বাস্থ্যঝুঁকিরও। আমাদের উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতার ওপর এটির যে বিরূপ প্রভাব, তা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আঘাত করে অর্থনীতিতে। তাই বিদেশি বিনিয়োগের অন্তরায়সমূহের মধ্যে যদি ঢাকার যানজট শীর্ষে উঠে আসে, সেটিকে উপেক্ষা করা যাবে না।
পৃথিবীর প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলোতে ঢাকার ট্রাফিক সম্পর্কে মাঝেমধ্যেই বিরূপ মন্তব্যসহ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। শুরুতেই নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্ট থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ ৯ জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, অর্থনীতিবিদেরা বলেন, সড়ক নির্মাণও অপর্যাপ্ত,Ñ যার আংশিক কারণ অতি উচ্চ ব্যয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের উদ্ধৃতি দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে এক কিলোমিটার সড়ক চওড়া করার খরচ যেখানে ১৫ লাখ ডলার, সেখানে বাংলাদেশে এই খরচ ১০ গুণ বেশি। নির্মাতারা অতিরিক্ত ব্যয় হাঁকান, এখান থেকে ভাগ বসান আমলা, রাজনীতিবিদসহ সবাই। এটা স্রেফ চুরি।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, যানজটের অর্থনৈতিক ক্ষতি স্পষ্ট। পোশাকশিল্পের কারণে অর্থনীতি ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতে পারত। ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকার যানজটের কারণে অর্থনীতির বার্ষিক ক্ষতি ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
স্পেনের পর্যটক জেনিফার বালিকো ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এক লেখায় লিখেছেন, ‘আমি যতগুলো শহরে গিয়েছি, তার মধ্যে ঢাকা হচ্ছে সবচেয়ে খতরনাক।’ অন্যত্র লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর বাংলাদেশের সব শহরেরই একই সমস্যা, এসব জনবহুল নগরকেন্দ্রে মানুষজন থাকার জন্য পাড়ি জমায়, তবে ঢাকা নিকৃষ্টতম।’
আমরা জানি, প্রতিবছর তিন থেকে চার লাখ মানুষ ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করছে। ফলে এটি পরিণত হয়েছে বিশ্বের ১১তম জনবহুল শহরে, যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৬ সালের বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা জরিপে বিশ্বের ১৪০টি নগরীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৭তম। ঢাকার পেছনে আছে মাত্র তিনটি শহর: লাগোস, ত্রিপোলি ও দামেস্ক।
আমরা ঢাকার যানজট সমস্যার বহুল আলোচিত কারণগুলো জানি, যেমন গাড়ির তুলনায় সড়কপথের স্বল্পতা, একই রাস্তায় চলা বিভিন্ন গতির যানবাহন, নির্দিষ্ট বাসস্টপের অভাব, নির্দিষ্ট লেন না মানা, চালকদের ট্রাফিক আইন বিষয়ে অজ্ঞতা ইত্যাদি।
কিন্তু আরও কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা জরুরি। চালকের অজ্ঞতা, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন এবং পুলিশের উদাসীনতা ও অসহায়ত্বÑ—এসব ছাড়িয়ে যে বিশৃঙ্খলা ঢাকার সড়কে দেখা যায় তার জন্য বহুলাংশে দায়ী পথচারীরা। এর মূল কারণ, জাতি হিসেবে আমাদের সহনশীলতার অনুপস্থিতি এবং সংক্ষিপ্ততম উপায়ে উদ্দেশ্য হাসিল করার মানসিকতা। (১) মাথার ওপর ফুটওভারব্রিজ রেখে ডিভাইডারের ওপর কাঁটাতারের বেড়া ফাঁক করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে (এমনকি পুলিশ সদস্যদেরও) রাস্তা পার হওয়া ঢাকার অতিপরিচিত দৃশ্য। শ্রম লাঘবের জন্য অন্তত দুটো সেতুতে লাগানো চলন্ত সিঁড়ির সুবিধা দিয়েও পথচারীদের সেতুমুখী করা যায়নি। পুলিশ কিছুদিন চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিয়েছে, যাতে প্রমাণিত হয় যে আমরা নাগরিক হিসেবে আধুনিক সুবিধাগুলো ভোগ করার যোগ্যতা রাখি না। (২) ঢাকার প্রধান সড়কগুলোর মধ্যে একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ছাড়া আর কোনোটিতেই সব লেন ব্যবহার করা যায় না। কারণ, আমরা এখনো যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি এবং পুলিশ উদাসীন ও অসহায়। (৩) যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়কের পর যে আট লেনবিশিষ্ট সড়ক তৈরি করা হয়েছে, তার সুফল আমরা পাইনি। অতএব, ষোলো লেনের রাস্তা করে দেওয়া হলেও আমরা সেটার চার লেনই মাত্র ব্যবহার করতে পারব। (৪) লেন মেনে গাড়ি চালানোর জ্ঞান আমাদের চালকদের নেই, পুলিশেরও আছে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে, অবৈধ লেন পরিবর্তনের জন্য কখনোই কোনো চালকের শাস্তি হওয়ার কথা শোনা যায়নি। বেআইনি লেন পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের সমাজের আরেকটি বাস্তবতা প্রতিফলিত হয় যে আইন ভঙ্গকারীরাই আইন মানা মানুষকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে। (৫) অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথরোধ না করলে সিগন্যালে লাল বাতি জ্বলার পরও না দাঁড়ানোর মতো আমাদের মজ্জাগত অসুস্থ মানসিকতা। (৬) রাস্তার মোড়ের ওপর বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর চরম বেআইনি ব্যবস্থাটা বন্ধ করতে পুলিশের বাড়তি অর্থ বা জনবলের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু সেটি রহস্যজনক কারণে করা হয়নি। আর, (৭) উল্টো দিকে গাড়ি চালানো তো নিয়মে পরিণত হয়েছে। পুলিশ বাধা দিতে এলে সরকারি দলের পাতিনেতাও তাকে হুমকি দেয়।
এসব কারণে বিদেশি পর্যটক, ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীরা ঢাকার ট্রাফিকের যে দৃশ্য দেখেন, তা তাঁদের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। তাঁদের মধ্যে যাঁরা কলম ধরেন, তাঁরা কী অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, তার কিছু নমুনা ওপরে দেওয়া হয়েছে। এসব লেখায় আমাদের জাত্যভিমানে ঘা লাগতে পারে, কিন্তু একটি শব্দও আমাদের অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ হিসেবে একটা স্পর্শকাতর ইঙ্গিত দেওয়া যায়। ঢাকার অন্যান্য রাস্তায় যে চালক বা পথচারীরা সভ্যতার চরম পরিপন্থী আচরণ করেন, তাঁরাই যখন সেনানিবাসের ভেতর চলাচল করেন, তখন পরিণত হন সভ্যতম দেশের নাগরিকে। এই দ্বিমুখী আচরণের কারণ কী, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? ভাবতে গেলে মনে হয়, ‘এই নাগরিক লইয়া আমরা কী করিব?’
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷