ডেলিভারিম্যানের কাজ করতেন নাহিদ হোসেন। কুড়ি বছর বয়সের এই যুবক থাকতেন কামরাঙ্গীরচরে। মাত্র সাত মাস আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। একটা কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারি-কর্মী। তিনি তাঁর পেশার কাজে গিয়েছিলেন নিউমার্কেট এলাকায়। তাঁর ১৮ বছর বয়সের স্ত্রী, সদ্য-বিধবা, মুঠোফোনে স্বামী নাহিদের ছবি দেখিয়ে বিলাপ করছেন। নাহিদ হোসেনের মা কাঁদছেন। নাহিদ হোসেনের বাবা কাঁদছেন। নাহিদ হোসেনের স্ত্রী কাঁদছেন। তাঁর দুটো ছোট ভাই আছে, তারা কাঁদছে। খবরের কাগজগুলো বলছে, মর্গ থেকে বের করে আনার পর দেখা যায়, নাহিদের আপাদমস্তক ছিল প্রহারের চিহ্ন।
কেন নাহিদকে মরতে হলো? কেন নাহিদের মায়ের বুক খালি হলো? কেন তাঁর স্ত্রী বিধবা হলেন?
এসব প্রশ্ন সবার। কিন্তু উত্তর কী?
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেট এলাকার দোকান-কর্মচারীদের মধ্যকার সংঘর্ষে মারা গেছেন আরও একজন—মাত্র ২৫ বছর বয়সের দোকান কর্মচারী মুরসালিন। তিনিও থাকতেন কামরাঙ্গীরচরে। স্ত্রীর নাম মিতু, তাঁর দুটো শিশুসন্তান আছে। ওই দুই শিশু বাবাহারা হলো, মিতু স্বামীহারা হলেন। জীবন এখানে এত সস্তা? কোনো কারণ ছাড়াই ঘটে যাবে বড় সংঘাত, সংঘর্ষ, রাস্তা হবে রণক্ষেত্র, মারা যাবে মানুষ!
২.
ঘটনার সূত্রপাত আগের রাতে। মানে ১৮ এপ্রিল ২০২২ রাতে। রাতেই এক দফা মারামারি হয়ে গেছে। নিউমার্কেটের দুই দোকানের কর্মচারীর মধ্যে বচসা হয়েছে। একজন খবর দিয়ে ডেকে এনেছেন ঢাকা কলেজের ছাত্রদের। তারপর আরও অ্যাকশন। ঢাকা কলেজের ছাত্ররা জানেন, তাঁদের একজন সতীর্থকে নিউমার্কেটে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। নিউমার্কেটের কর্মচারীরা শুনেছেন, তাঁদের ওপরে হামলা করতে আসছেন ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। পরের দিন সকালে, গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, ঢাকা কলেজের ছাত্ররা সমবেত হচ্ছেন অবস্থান ধর্মঘট করতে, তাঁদের ওপরে হামলার প্রতিবাদ করতে। আর সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় সমবেত হচ্ছেন মার্কেটের কর্মচারীরা। আগের রাতে যে সংঘাতের সূত্রপাত, তা পরের দিন আবারও নতুন করে শুরু হলো। সারা দিন ধরে চলল। কারও কোনো দায়িত্ব নেই? কোনো গোয়েন্দা সংস্থা নেই, কোনো ‘ইনফরমার’ নেই!
ব্যবস্থা মানে কি শুধুই পুলিশি ব্যবস্থা? কর্মচারীরা ঢিল ছুড়ছেন ছাত্রদের প্রতি, ছাত্ররাও নিশ্চয়ই বসে থাকবেন না, শুরু হলো, প্রাক্-আধুনিক যুদ্ধ, ঢিল-ছোড়াছুড়ি। লাঠি হাতে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। কিরিচের প্রদর্শনী। হেলমেট বাহিনীর মহড়া। পুলিশের কাজ হলো কাঁদানে গ্যাস ছোড়া, রাবার বুলেট ছোড়া, লাঠিপেটা করা! একজন নেতাকে দেখা গেল না, যিনি এগিয়ে আসবেন সমঝোতার বার্তা নিয়ে! বিপুলসংখ্যক মানুষ আহত হলেন—পুলিশ, পথচারী, ছাত্র, কর্মচারী এবং অবশ্যই সাংবাদিক। এখন আহত ছাত্রকে দেখতে যাচ্ছেন মন্ত্রীরা, সুচিকিৎসার আশ্বাস আসছে। কিন্তু সময়ের এক ফোঁড় কি অসময়ের নয় ফোঁড়কে থামাতে পারত না! দেশটা কি অটোগিয়ারে চলছে? আমাদের নেতারা, কর্মকর্তারা, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা, রাজনীতিবিদেরা—কোথাও কেউ নেই?
পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করি, আহত ব্যক্তিরা সুস্থ হয়ে উঠুন। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়! এখন ওপরওয়ালার দরবারে দুহাত তুলে ফরিয়াদ জানানো ছাড়া আমাদের কারও কিছু করার নেই?
৩.
কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকার চলতি সংখ্যায় বাঙালির সহিংসতা আর নিষ্ঠুরতার ইতিহাসের খানিকটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টিকোণ থেকে (দেশ, ২২ এপ্রিল ২০২২, চলে নিরন্তর, সুপ্রিয় চৌধুরী)। পূর্ব বাংলার মানুষের নিষ্ঠুরতার ইতিহাসও কম ভয়াবহ নয়। টোটেম বা গোত্রলক্ষণ এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের মধ্যে স্পষ্ট। পাড়ায় পাড়ায় মারামারি হয়। গ্রামে গ্রামে মারামারি হয়। ১৭ এপ্রিল ২০২২-এর খবর: হরিণাকুণ্ডুতে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত, আহত ৯। দুই গ্রামের দুজনের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই সংঘাত-সংঘর্ষ। এই ধরনের খবর প্রায় প্রতিদিনই থাকে। বিবিসি বাংলার এই খবরকে এখন কি কেউ বিশ্বাস করবেন, ‘ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা: কোপা আমেরিকার ফাইনাল ঘিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাজার পুলিশ মোতায়েন।’ ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হয়! তা থামাতে হাজারো পুলিশ মোতায়েন করতে হয়!
ছাত্রদের সঙ্গে দোকান কর্মচারীদের মারামারি, ছাত্রদের সঙ্গে পরিবহনশ্রমিকদের সংঘর্ষ, এক কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে আরেক কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ, কত সামান্য আর কত বিচিত্র কারণে যে সংঘর্ষ বাঁধতে পারে, আর তা কত ভয়াবহ রূপই না পরিগ্রহ করতে পারে! মাত্র কয় বছর আগে ছেলেধরা সন্দেহে বাড্ডা এলাকায় স্কুলের সামনে থেকে শিক্ষার্থীর মাকে পিটিয়ে মেরেছে জনতা।
সব কিছুর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অদক্ষতা, নিষ্ক্রিয়তা, দায়িত্ব পালনে অনীহা। হকাররা ফুটপাতে বসেন, তাঁদের চাঁদা দিতে হয়। সেই চাঁদার ভাগ ইনি পান, উনি পান। ছাত্ররা আবার বিশেষ দল করেন। তাঁদের একটা ক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপার থাকে। ক্যানটিনে দু-একটা কাপ না ভাঙলে বয়-বেয়ারারকে দু-চারটা চড়থাপ্পড় না মারতে পারলে ভাইয়ের তো ভাইগিরি থাকে না।
ডাকাত সন্দেহে বেড়াতে আসা যুবকদের পিটিয়ে মেরেছে গ্রামবাসী—গাবতলীর ওই পারের গ্রামের এই ঘটনার স্মৃতি আমাদের মন থেকে মুছে যায়নি। আমরা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে পড়েছি:...“ফুটবল ম্যাচ। সন্ধ্যা হয় হয়। মগ্ন হইয়া দেখিতেছি। আনন্দের সীমা নাই। হঠাৎ—ওরে বাবা—এ কি রে! চটাপট শব্দ এবং মারো শালাকে, ধরো শালাকে। কি একরকম যেন বিহ্বল হইয়া গেলাম। মিনিট দুই-তিন! ইতিমধ্যে কে যে কোথায় অন্তর্ধান হইয়া গেল, ঠাহর পাইলাম না। ঠাহর পাইলাম ভালো করিয়া তখন, যখন পিঠের উপর একটা আস্ত-ছাতির বাঁট পটাশ করিয়া ভাঙ্গিল এবং আরও গোটা দুই-তিন মাথার উপর, পিঠের উপর উদ্যত দেখিলাম।’ আশির দশক পর্যন্ত মোহামেডান আর আবাহনীর সমর্থকেরা মারামারি বাধাতই ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকায়। মানুষের মৃত্যুও হতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেট্রোপলিটন কলেজের দুই দল ছাত্রের মারামারি ঠেকাতে নিজের চটি জুতা হাতে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ইতিহাস পড়ার সময়ও আমরা খেয়াল করি যে সে আমলেও দুই দল ছাত্র মারামারি করত। তা থেকে তো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি, শুধু চটি জুতা হাতে মারামারি থামানোর মতো শিক্ষক আমরা আর খুঁজে পাই না। আমাদের মধ্যে এই যে টোটেম মানসিকতা, ‘আমাদের পাড়ার ছেলের গায়ে ওদের পাড়ার ছেলে হাত তুলেছে, চলো, ঢাল তলোয়ার টোটা বন্দুক সড়কি বল্লম নিয়ে দলে দলে বেরিয়ে পড়ো’—এটা কেন যায় না? কেন আমরা গোলযোগ দেখলে লাঠিসোঁটা হাতে বেরিয়ে না পড়ে ৯৯৯–এ কল করি না, মুরব্বিদের ডাকি না! আমরা কবে সভ্য হব?
৪.
এসব কিছুর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অদক্ষতা, নিষ্ক্রিয়তা, দায়িত্ব পালনে অনীহা। হকাররা ফুটপাতে বসেন, তাঁদের চাঁদা দিতে হয়। সেই চাঁদার ভাগ ইনি পান, উনি পান। ছাত্ররা আবার বিশেষ দল করেন। তাঁদের একটা ক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপার থাকে। ক্যানটিনে দু-একটা কাপ না ভাঙলে বয়-বেয়ারারকে দু-চারটা চড়থাপ্পড় না মারতে পারলে ভাইয়ের তো ভাইগিরি থাকে না।
৫.
ঢাকা কলেজ-নিউমার্কেট এলাকার সংঘর্ষে নিহত নাহিদের স্ত্রী ডালিয়ার ছবি দেখছি প্রথম আলো অনলাইনে। ডালিয়ার হাতে লেখা: আই লাভ ইউ নাহিদ। হাতে মেহেদি দিয়ে লিখেছেন তিনি স্বামীর জন্য ভালোবাসার বার্তা। সাত মাসের সংসারের স্মৃতি নিয়ে ডালিয়া এখন হতবিহ্বল। নাহিদের ছোট ভাই দুটো খুবই ছোট, শরীফের বয়স সাত বছর ও ছোট ভাই ইব্রাহিমের বয়স তিন বছর। এখন নাহিদের স্ত্রীর ছবি দেখে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমরা আর কী করতে পারি? মুরসালিনের জন্য রোদন ছাড়া আমরা আর কী করতে পারি?
আমরা শুধু চিৎকার করে বলতে পারি, দায়িত্ববানদের কেউই কেন সকাল সকাল হাজির হলেন না ঘটনাস্থলে? কেন সারাটা সকাল অরক্ষিত পড়ে থাকল নিউমার্কেট-ঢাকা কলেজ এলাকা? কেন ব্যবস্থা মানে কেবল পুলিশি ব্যবস্থা? আমাদের নেতারা কোথায়? আমাদের কর্তারা কোথায়? আমাদের নগরপতিরা কোথায়? আমাদের সমাজপতিরা কোথায়? আমাদের সরকার ও প্রশাসনই–বা কোথায়? সমাজপতিরা, কর্তারা সঠিক সময়ে এগিয়ে এলে এই সংঘাত এড়ানো যেত, মূল্যবান দুটো প্রাণের অপচয় রোধ করা যেত, এত বড় ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত না! খোদ ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র প্রায় ১৮ ঘণ্টা অভিভাবকহীন রয়ে যেতে পারে কীভাবে, এটা ভাবলে গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসছে! এটা কীভাবে সম্ভব!
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক