জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠানে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব। বিগত বছরের শেষ সপ্তাহে ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ রোজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় শ্রেষ্ঠদের স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি।
সচিব মহোদয় সুনির্দিষ্ট উদাহরণসহ নানা ধরনের দুর্নীতি, অন্যায় উমেদারি আর হামবড়া ভাবের নিন্দা করেন। বলা বাহুল্য, এঁরা সবাই রাষ্ট্রের কুলীন ক্যাডার প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিসের সদস্য। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছেন, এমন কোনো দিন নেই যেদিন তাঁকে এসব দুর্নীতি নিয়ে দায়ের করা বিভাগীয় মামলার ফাইল নিয়ে বসতে হয় না।
এসব মামলায় অনেকের শাস্তিও হচ্ছে। আবার অনেকে মাঠপর্যায়ের অপরাধ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পদ আঁকড়ে রাখার জন্য, রাজধানীতে থাকার জন্য লাগাতার তদবিরও করছেন।
এসব হতাশার বয়ানের পাশাপাশি তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁরা দক্ষতা, যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন না, তাঁদের চাকরিতে থাকার প্রয়োজন নেই। সচিবের এ রকম উচ্চারণে মনে হতে পারে মাঠঘাট দুই নম্বরিতে ভরে গেছে। ভরে না গেলেও বেড়ে যে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। রাষ্ট্রের অনেক কর্মকর্তা–কর্মচারী আছেন, যাঁরা পুরস্কার–তিরস্কারের পরোয়া না করে বিবেকের তাড়নায় চাকরির টাকাকে হালাল করার জন্য সততার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। তাঁদের জন্যই বোধ করি পুরস্কার সনদ ইত্যাদির ব্যবস্থা। কুলীন ক্যাডারের সদস্যদের অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত রাখার জন্য তাঁদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তিতে বলীয়ান করার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকের সুপারিশে বিভাগীয় কমিশনার বার্ষিক পুরস্কারের আয়োজন করেন।
যাঁরা সুপারিশ করেন, তাঁদের যে ভুলচুক হয় না, সেটা বলা যাবে না। আবার সৎ মানুষকে ‘পাগল’ ভেবে পুরস্কার–পদোন্নতি দুটো থেকেই বঞ্চিত করার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে ক্যাডারে, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর, বিভাগে, বিভাগে। ভালো হলে কী হবে, উনি তো আমাদের লাইনের না। লাইনের লোক হওয়াটা প্রথম বিবেচ্য, অন্য প্রমাণগুলো গৌণ।
বিশেষ ব্যাচের ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান শেষমেশ যুগ্ম সচিব হয়েছিলেন। ব্যাচের কারও আগে তো নয়ই বরং প্রায় সবার পরে পেয়েছিলেন সে পদটা। অথচ তাঁর দাপ্তরিক কাজ, সময়জ্ঞান, জীবনযাত্রা, সততা, নিষ্ঠা সবই ছিল কিংবদন্তিতুল্য। এ দেশে দুর্গম জেলা–উপজেলাগুলোতে বদলি করে অপছন্দের আমলাদের শাস্তি দেওয়ার এক রীতি চালু আছে, সেটাকে আমলাতন্ত্রের ভাষায় বলে ‘পানিশমেন্ট পোস্টিং’। আজকাল নাটকে–বিজ্ঞাপনে আবদার না রাখলে বান্দরবান, থানচি, তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়ে বদলির হুমকি দিতে দেখা যায়। সততার মূল্য দিতে ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানকে এ রকম বদলি হতেও হয়েছে।
শোনা যায়, একবার এক প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতির মা তাঁকে এক অন্যায় আবদার জানালে তিনি নাকি তাঁকে বলেছিলেন, ‘মা, অবশ্যই আমি আপনার ছেলের মতো। আপনি দোয়া করবেন, এ তো খুশির কথা। এক কাজ করেন, আপনার বড় ছেলেকে বলে এই ছোট ছেলেকে এখান থেকে বদলির ব্যবস্থা করেন। তাহলে হয়তো আপনার আত্মীয়দের উপকার হতে পারে।’ বলা বাহুল্য, এ রকম আশ্চর্য বেয়াদবির ফল তিনি হাতে হাতে পেয়েছিলেন। দেশের সর্ব উত্তরের জেলায় তাঁকে তাঁর সততা দেখাতে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল।
গণতন্ত্রের জয়যাত্রায় গণেশ ওল্টালেও মিজানুর রহমানদের কপালে একই দুর্ভোগ থেকে যায় আঠার মতো লেপটিয়ে। রাষ্ট্রপতিদের বদলে আসে প্রধানমন্ত্রীদের যুগ। মন্ত্রিসভার এক নম্বর মন্ত্রী তাঁর এক দিলপাহেচানের জামিন চেয়ে কোনো এক জেলা প্রশাসকের কাছে সালাম পাঠালে নিরুপায় জেলা প্রশাসক তাঁকে বিনীতভাবে বলেন, ‘স্যার, আমি বড় বিপদে আছি। আমার এক পাগল ম্যাজিস্ট্রেট কারও কথা শোনে না। আপনি নিজে বললে ভালো হয়।’ এক নম্বর মন্ত্রী ‘নিজে’ বলেছিলেন। বলা বাহুল্য, তাতেও কাজ হয়নি। এ রকম মিজানদের তুলাদণ্ডে কোনো ফের নেই, তাই তাঁদের জন্য কোনো পুরস্কার নেই, পদোন্নতিও নেই।
সম্প্রতি নয়জন ভূমিপুত্রকে নিয়ে মাধবকুণ্ডে ঘটে যাওয়া লঙ্কাকাণ্ড পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে। বার্ষিক পূজার আচার পালনে মাধবকুণ্ডের ইকোপার্ক এলাকায় শিকারকৃত্যে গিয়েছিলেন তাঁরা। চুরি–ডাকাতির আর গাঁটকাটাদের সাক্ষী বনপ্রহরীরা ‘চোর চোর চাই নইলে রাজার যাবে মান’ জপতে জপতে জাপটিয়ে ধরেন তাঁদের। তাঁদের কাছে মেলে এক পথহারা শজারু শাবক। তাতেই তাঁদের জেল–জরিমানা হয়ে যায়। যদিও আইন বলছে, (বন্য প্রাণী আইনের ৫০ নম্বর ধারা), সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কাজকর্মের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তার জন্য কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনি কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল গরিব প্রান্তিক ভূমিজদের এসব আইনের প্যাঁচে নিজেদের প্যাঁচানোর তাকদ নেই। তাই জুলুম হলেও জেল–জরিমানা মেনে নিতে হয় তাঁদের। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু বড়লেখা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনার পর দণ্ডিতদের পারিবারিক ও সামাজিক তথ্য জানার চেষ্টা করেন। একজন পোক্ত আমলা, যিনি লাইনে থাকলেই যার দমাদম উন্নতি, তাঁর জন্য দণ্ডিতদের সমাজ জীবন জানা–বোঝার চেষ্টা নিঃসন্দেহে নতুন এক জনদরদি প্রচেষ্টা।
সমাজ জীবন বুঝতে গিয়ে তিনি হয়তো অনুধাবন করেছেন বনবাসিদের প্রতি রাষ্ট্রের অন্যায্য বিবেচনাকে অসহনীয় মাত্রা প্রয়োগ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছেন সাজাপ্রাপ্ত গৃহহীনদের তিনি সরকারি গৃহায়ণ কর্মসূচির আওতায় ঘর বানিয়ে দেবেন। গত ২২ ডিসেম্বর ঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। নির্বাহী কর্মকর্তার এই পদক্ষেপকে নিন্দুকেরা যতই গরু মেরে জুতা দান বলুক না কেন তাঁর এই প্রচেষ্টা আরও বিকশিত হোক। প্রশাসনের নজরে আসুক বৃত্তের বাইরে গিয়ে স্বাধীনতার সুফল জনতার দরজায় পৌঁছে দেওয়ার এই চেষ্টা।
পদক প্রশংসা তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা লাইন ছাড়া কর্মপাগল আর সৎ কর্মচারী–কর্মকর্তাদের সততার সঙ্গে চিহ্নিত করতে সাহস পাব
একই যাত্রায় দুই ফল
ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে থাকা একজন সাবেক এসি ল্যান্ডের অর্জনের বর্ণনায় বলা হয়েছে। দীর্ঘদিনের জরাজীর্ণ ভূমি কার্যালয়টির পাশে নতুন ভবনের চারপাশ ঘিরে তৈরি করেছিলেন সবুজের সমারোহ, সেবাগ্রহীতাদের জন্য আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। একই কাজ আরও মোহনীয় আর দৃষ্টিনন্দন, সৃষ্টিশীল আর দূরদৃষ্টি দিয়ে গড়ে তুলে এখন তিরস্কৃত হচ্ছেন অন্য এক সৃষ্টিশীল কর্মকর্তা। কুমিল্লার পাঠকেরা ময়নামতি গেলেই এই সৃষ্টি কাজের নমুনা দেখতে পাবেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পতিত জমিতে তিনি বাগানের ছলে গড়ে তুলেছেন কুমিল্লা অঞ্চলের সর্ববৃহৎ ভেষজ বাগান। শুধু তুলসীগাছের ঝাড় আছে চার হাজারের বেশি। এসবই তিনি করেছেন অতিমারির লকডাউন বা বন্ধের সময়।
চট্টগ্রাম প্রত্নতত্ত্ব অঞ্চলের প্রধান কর্মকর্তার এই ভেষজ সংগ্রহকে এক জীবন্ত ভেষজ জাদুঘর বললে কম বলা হবে। ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ সস্তা নিলামে না চড়িয়ে গাছের আদলে দর্শকদের জিরানোর বেঞ্চ বানিয়েছেন। ময়নামতির পেছনের গ্রামের ধানখেতের ধান কেটে দিয়েছেন অতিমারির শ্রমিক সংকটের সময়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে রক্ষণাবেক্ষণে বসে থাকা শ্রমিকেরা তাঁর সঙ্গে হাত লাগিয়েছিলেন। সব ভেষজ গাছের মূল উৎপাটনের নোটিশে পাশাপাশি তাঁকে আটকানোর নানা কূট কৌশলে এখন জেরবার তিনি। অথচ শুধু তুলসীপাতা বেচে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় রাজস্ব সংগ্রহে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারতেন। এই বর্ণনা শুনে বা পড়ে মানে হতে পারে প্রত্নতত্ত্ব কর্মকর্তা তাঁর আসল কাজ ছেড়ে কবিরাজি ধরেছেন। জৈন্তাপুর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত তাঁর কর্ম এলাকা নতুন নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চিহ্নিত ও সংরক্ষণের কাজে তাঁর মতো করিতকর্মা মানুষের হদিস মেলা কঠিন। এক রাতের বেশি নিজ অফিসের বাইরে না থাকার নির্দেশ জারি করে এই কর্মকর্তাদের টেবিলের পাশে বসিয়ে রাখলে ক্ষমতা জাহির করা যাবে, কিন্তু দেশের লাভ কি তাতে।
এই জনপদে আখতার হামিদ খানের মতো মানুষকে তাঁর বৃত্ত ভেঙে কাজ করার জন্য কি কম হেনস্তা হতে হয়েছিল। আমরা বছর, দশক আর পঞ্চাশ পার করেছি ক্যালেন্ডারে; আদতে দাঁড়িয়ে আছি আগের জায়গাতেই।
বৃত্তের বাইরে গিয়ে প্রশংসনীয় কাজের আরেক উদাহরণ তৈরি করেছে গাজীপুর জেলার প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি। প্রথম আলোর শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বয়স্কদের মধ্যেও তাঁরা শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। মধ্য আমেরিকার দেশ হন্ডুরাসের প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে গাজীপুরের শিক্ষকদের নিশ্চয়ই কোনো যোগাযোগ নেই (সেখানকার শিক্ষকেরা লকডাউনে স্কুল বন্ধ করলেও মিড ডে মিল বন্ধ করেননি। এক বেলার খাবার গরিব শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁরা) কিন্তু ঠিক ঠিক বুঝে ফেলেছেন কী করতে হবে। এটাই সৃজনশীলতা, এটাই উদ্ভাবনী। এই কাজগুলোকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। বাগড়া দিলে সৃজনশীলতা উঁকি দেবে না, উদ্ভাবনী শক্তি ডানা মেলবে না।
অনেক আশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে জনপ্রশাসন পদক চালু করেছিলেন। সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমের স্বীকৃতি দিতেই এই পদক। এটা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে পরিচিত। পদকপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা নামের শেষে পিএএ (PAA) যুক্ত করতে পারেন।
তবে পদক প্রশংসা তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা লাইন ছাড়া কর্মপাগল আর সৎ কর্মচারী–কর্মকর্তাদের সততার সঙ্গে চিহ্নিত করতে সাহস পাব।
গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক
[email protected]