আমরা কেন পারি না

বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের বিচারে সোচ্চার ছিল সবাই। সেই বিচার হতে যাচ্ছে, কিছু বিচার হয়েছেও। অভিযুক্ত ২৬ জন বুয়েট থেকে চিরতরে বহিষ্কৃত হয়েছে। আদালতের বিচারে এদের অনেকের কঠিনতম শাস্তিও হতে পারে। আবরার ও তার সঙ্গে সঙ্গে আরও ২৬ জন মেধাবী ছাত্রের জীবন এভাবেই শেষ হয়েছে। শেষ হয়েছে তাদের ঘিরে ২৭টি পরিবারের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ও র‌্যাগিংও নিষিদ্ধ হয়েছে। আমাদের অনেকেই এ নিয়ে তৃপ্ত হয়েছেন। আবরারের হত্যাকারীদের বিচারের পর এ নিয়ে আরও অনেক সাফল্যের কথাও বলা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো আসল সমস্যার সমাধান হলো কি এসবে? সুরাহা হলো আসল অপরাধের?

আবরার যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে, তেমন নির্যাতন কমবেশি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মৃত্যুর পর তাই প্রতিবাদ হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেখানে সবাই বলেছেন নির্যাতনের প্রধান কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে বিরাজমান চরম অরাজকতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুসারে এসব ছাত্রাবাসে আসন বণ্টন করা এবং তার সুষ্ঠু তদারক করার দায়িত্ব হল প্রশাসনের। হল প্রশাসনে থাকেন প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, সহকারী হাউস টিউটররা—যাঁদের প্রত্যেকে বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক। এ কাজ করার জন্য তাঁরা বিনা মূল্যে বাসস্থান, ভাতা ও অধীন কর্মচারী পান, পান চাকরিতে প্রমোশনের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনাও।

কিন্তু ছাত্রাবাসের আসন বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা আসলে করে সরকারি ছাত্রসংগঠনগুলো। এ নিয়ে হল প্রশাসনের শিক্ষকেরা কখনো কখনো অসহায়ত্বও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একবারও তাঁদের কেউ ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগ করেছেন, এমন দেখা যায়নি। যে কাজটি তাঁরা একেবারেই করতে পারছেন না, সে কাজের জন্য কেন বাসস্থান, ভাতা আর সুবিধাদি নিচ্ছেন, এই নৈতিক প্রশ্নও তাঁদের বিব্রত করেনি।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে জরুরি ছিল হলে হলে গণরুমগুলোতে সরেজমিন পরিদর্শনের। সে সময় বিভিন্ন প্রতিবাদ সমাবেশে এ কাজের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সবার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল বড় বড় কথাবার্তায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল প্রশাসন এ কাজ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০-১২ জন শিক্ষক নিজ উদ্যোগে প্রতি হলেও কাজটি শুরু করতে পারেননি। সবচেয়ে যা দুঃখজনক, এ জন্য তাঁরা একত্র হওয়ার প্রয়োজনও বুঝতে পারেননি। বাম ঘরানার নেতৃস্থানীয়রা জাতীয়তাবাদী গন্ধের শিক্ষকদের দূরে রাখতে চেয়েছেন, জাতীয়তাবাদীরা দ্বিধান্বিত থেকেছেন, সরকারের সমর্থকেরা সরকারকে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নামানো থেকে বিরত থেকেছেন। সাধারণ শিক্ষকেরা এসব বুঝে সবার থেকে দূরে থেকেছেন।

এ কাজ করতে এমনকি ছাত্ররাও একত্রভাবে মাঠে নামতে পারেনি। ডাকসু ভিপির নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ যখন এ নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছে, বাম সংগঠনগুলো ও অন্যরা তখন স্বতন্ত্র মিছিল করে আশপাশ প্রকম্পিত করেছে। যে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো অন্যায়ে ১০-১২ বছর আগেও সবাই একত্র হয়ে প্রতিবাদ করত, তা এভাবে শতচ্ছিন্ন থেকেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব পালনের সময়ও। ফলে আসল কাজ কিছুই হয়নি। হলগুলো থেকে গেছে ছাত্রলীগের কঠোর নিয়ন্ত্রণেই।

এমন এক পরিস্থিতিতে ডাকসুর ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক তাদের কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে গিয়েছিল বিজয় একাত্তর হলের গণরুম পরিদর্শনে। সেখানে সে ছাত্রলীগের বাধার সম্মুখীন হয়, এ কাজ করার জন্য সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছ থেকেও তিরস্কৃত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মনগড়া অপবাদ নিয়ে মাঠে নামে সরকার সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নেতৃত্বে গঠিত একটি সংগঠন।

মনে হচ্ছে, এ দেশে বা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায্য কাজে খুব সংগঠিত জোট আছে সব সময়। নেই শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদে জোট বা ঐক্য।

২.
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সব সময়ে করা হয়েছে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর মাধ্যমে। এ দেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বড় আন্দোলন গড়ে উঠে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা চট্টগ্রাম-রাজশাহীর মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট আন্দোলন থেকে অতীতে সরকার পতনের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

এই ‘আশঙ্কা’ যেকোনো মূল্যে দমন করানোর জন্যই সরকারগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সরকারি ছাত্রসংগঠনে ব্যাপক সংখ্যায় যাতে ছাত্ররা যোগ দেয়, এ জন্য তারা ছাত্রাবাসের আসনসংকট পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে থাকে।

দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী আসে অন্য এলাকা থেকে (যেমন ঢাবিতে প্রায় ৩৬ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কমপক্ষে ২৪ হাজার)। এদের মধ্যে বড়জোর এক-তৃতীয়াংশকে ছাত্রাবাসে থাকার সুবিধা দেওয়া যায়। মেধার ভিত্তিতে এটি হল প্রশাসনের বণ্টন করার কথা। তারা এ দায়িত্ব ছেড়ে দেয় সরকারি ছাত্রসংগঠনের ওপর। সরকারি ছাত্রসংগঠনের নেতারা প্রথমে নবাগত ছাত্রদের ঠেসে ঢোকায় গণরুমে, সেখানে থাকাকালে বাধ্য করে তাদের সব নির্দেশ পালন করতে। তা মেনে চলতে পারলে ছাত্রাবস্থায় হলে কক্ষ বরাদ্দ পাওয়া যায়, সেখানে নিরাপদে থাকা যায়, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় অনুকূল পুলিশি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। কেউ কেউ লোভী হয়ে কিন্তু বাকি অনেকে তাই অসহায় হয়েই যুক্ত হয়ে পড়ে সরকারি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে।

পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এমন দাস বানানোর কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে আমার জানা নেই। এই কারখানা নিরাপদে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় সরকার অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের পুলিশ, গোয়েন্দা এমনকি আইন-আদালত ব্যবস্থাও। এ জন্য কোটা আন্দোলনে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নিজে তা সগর্বে জানানোর পরও আমরা সরকারি ছাত্রসংগঠনের এক কর্মীকে কোনো রকম বিচারের সম্মুখীন হতে দেখিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একবুক স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা আসে মুক্ত মানুষ হতে, মুক্ত মননশীলতা চর্চা করতে। হলে থাকতে দেওয়ার বিনিময়ে দাস বানানো হয় তাদের। পড়াশোনা শিকেয় তুলে অপরাজনীতির দাসবৃত্তিতে বাধ্য করা হয় তাদের।

৩.
এ অবস্থার প্রতিকার কী, তা নিয়ে বহু কিছু বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রয়োজনে সিনিয়র ছাত্রদের আসন কমিয়ে হলে আসন বণ্টন করার ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান, হলের প্রতিটি রুমের আসনসংখ্যা বৈধভাবে দ্বিগুণ করা, হলের প্রবেশপথ, বারান্দা ও অতিথি রুমে সিসিটিভি স্থাপন, হলে ছাত্রদের ডেটাবেইস তৈরিসহ বিভিন্ন প্রস্তাবও ছিল।

এসব প্রস্তাব দিয়ে কোনো লাভ নেই, সেটা সবাই জানেন। জানেন যে কোনো দিন সরকার, তাদের অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারি ছাত্রসংগঠন এ পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে চাইবে না। এ জন্য তারা ব্যবহার করবে বৈধ-অবৈধ সব ক্ষমতা। সবাই জানে যে এ কাজে কতটা ঐক্যবদ্ধ তারা।

আমার তাই একটাই প্রশ্ন, আমাদের মধ্যে যারা নির্যাতিতদের পক্ষে, তারা কি সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না? গ্রামে ডাকাত পড়লে সাহায্য করার জন্য সবাই ছুটে যাই। ছুটে যাওয়া মানুষকে আমরা জিজ্ঞেস করি না তার নাম কী, কী তার পরিচয়। বহু আগে বিএনপির সময় ছাত্রী মিছিলে হামলার বিরুদ্ধে, তার আগে এরশাদের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে, তারপরে ওয়ান-ইলেভেনের সময় ছাত্রদের অপমানিত হওয়ার বিরুদ্ধে বাকিরা একসঙ্গে সবাই রুখে দাঁড়িয়েছিল।

এখন কেন সেভাবে দাঁড়ানো যায় না? এখন কেন কয়েক হাজার ছাত্র-শিক্ষক একটা একটা করে হলে গিয়ে সেখানে দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়ার দাবি করতে পারে না?

আমাদের বুঝতে হবে বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদে কোনো দিন সাফল্য আসে না কোথাও। বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদে কোনো দিন সুরক্ষা হবে না আবরার, আবু বকর বা জুবায়েরের মতো সাধারণ ছাত্রদের।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক