আমরা কত দূর এগোলাম
আমাদের দেশের উন্নয়ন বা অগ্রগতি নিয়ে আমরা যখন কিছু বলতে চাই, তখন বলতে হয়, কিসের তুলনায় অগ্রগতি। যেমন, ১৯৭০–এর দশকের কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের তুলনায় বর্তমানের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অনেক উন্নত। কিন্তু একই সময়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের যে অগ্রগতি হয়েছে, তার তুলনায় আমাদের অগ্রগতি বলার মতো নয়। নিজের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা অগ্রসরমাণ। অন্যান্য দেশের তুলনায় ততটা নই। শুধু কুয়ালালামপুর নয়; সিঙ্গাপুর, দোহা, দুবাই, ইস্তাম্বুল কিংবা চীনের বিমানবন্দরগুলোর তুলনায়ও আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
পৃথিবীর গড় জনঘনত্বের ২৪ গুণ বেশি জনঘনত্ব বাংলাদেশের। আমরা কি আমাদের অসামর্থ্যগুলোর কথা ভাবি? সামর্থ্য বাড়ানোর উপায় নিয়ে চিন্তা করি? আলোচনা করি? শুধু শুনি উন্নয়নের জোয়ার বইছে, অন্যান্য দেশে সম্ভবত এই মাত্রায় ঢাক পেটানো হয় না।
আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হতে হলে আর কত দূর যেতে হবে? পাকিস্তানের অন্যায় শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ–বঞ্চনা থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকে নানা খাতে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আমরা শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এখনো অনেক পিছিয়ে। অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের হাতিয়ার হলো শিক্ষা। কিন্তু গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারের কাজ খুব সামান্যই হয়েছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। একুশ শতকের পৃথিবীতে অন্যদের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে হলে গড়ে তুলতে হবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড—এই প্রাচীন আপ্তবাক্য উচ্চারণই যথেষ্ট নয়। শিক্ষার মান উন্নীত করতে হবে আন্তর্জাতিক স্তরে। এ ছাড়া আমাদের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হবে। অন্যদের তুলনায় আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব।
সম্প্রতি ইউরোপ গিয়েছিলাম পর্তুগালের পোর্তো শহরে ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্ট (আইসিপিসি) বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের নিয়ে। আজ থেকে ২১ বছর আগে আমরা এই প্রতিযোগিতায় প্রথম অংশগ্রহণ করেছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে। সেবার গিয়েছিলাম বাংলাদেশ বিমানে, আর এবার পর্তুগাল যেতে হলো তুর্কি এয়ারলাইনসে। বাংলাদেশের এত অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু আমাদের জাতীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমানের গন্তব্যের সংখ্যা কমেছে। কয়েক বছর আগেও তুর্কি এয়ারলাইনসের গন্তব্য ছিল দুই শতাধিক, এখন তারা বলছে তাদের গন্তব্যের সংখ্যা বেড়ে তিন শ পেরিয়েছে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের স্থান বদলানো হয়েছে। শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ১৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জায়গার ওপরে ৫৬৬ চেকইন কাউন্টার, ২২৮টি পাসপোর্ট কন্ট্রোল পয়েন্টসমৃদ্ধ নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। আর আমরা কী করেছি? আমাদের উন্নতি হয়েছে না অবনতি?
যাহোক, পর্তুগাল থেকে ফেরার পথে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বন্ধু মোশারফ হোসেনের বাসায় অতিথি হলাম। তিনি জার্মানিতে ৪০ বছর ধরে বাস করেন। তাঁর দুটি মেয়ে ডার্মস্টাড টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। তারা সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে আসে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্গত মানুষদের জন্য সাহায্য পাঠায়। আমার পরের গন্তব্য ছিল নিউইয়র্ক। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে সেখানে পৌঁছালাম।
নিউইয়র্কে ড. মাসুদের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে মিলওয়াকি শহরে চলে গেলাম। প্রায় ৩০টি ফ্ল্যাটের একটি ভবনে বেসমেন্টে দেখি দুটি ওয়াশিং মেশিন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। সেগুলো ভবনের সবার জন্য। প্রতিটি ফ্ল্যাটে ওয়াশিং মেশিন রাখার প্রয়োজন নেই। এর আগে একবার দেখেছিলাম, শহরের একটি বড় কক্ষে অনেক মানুষ তাদের কাপড়চোপড় পরিষ্কার করার জন্য অপেক্ষা করছিল; খোদ আমেরিকায়। আমাদের দেশেও এই ধরনের যৌথ সুবিধার ব্যবস্থা করা যায় কি না, ভেবে দেখা উচিত। আমাদের যেটুকু সুযোগ-সুবিধা আছে তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হোক, আমরা যাতে করে কোনো কিছুরই অপচয় না করি।
আমাদের সীমিত সম্পদ, মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্বের বিষয়টি বিবেচনা করে এ বিষয়গুলোর একটি ইতিবাচক সূচনা হওয়া উচিত। মিলওয়াকি শহরে অবস্থিত মার্কেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শেখ ইকবাল আহমেদের উদ্যোগে আমাদের দেশের অনেক ছাত্রছাত্রী এখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অন্যান্য শহরেও বাংলাদেশি শিক্ষকেরা একইভাবে অবদান রেখে চলেছেন। কয়েক দিন আগে ডালাস শহরে বাংলাদেশিদের এক সম্মেলনে শিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে উত্তর আমেরিকাপ্রবাসী বাংলাদেশিরা কীভাবে অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হলো। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে এসব শুভ উদ্যোগ বাস্তবে রূপ লাভ করবে। আমরা প্রকৃত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন অচিরেই বাস্তবায়ন করতে পারব।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস