প্রকৃতিকে জানান দিয়ে আসছে আমের মৌসুম। দেশের সব এলাকাতেই গাছে গাছে এখন আমের গুটি। ফাগুনের আমের বোলের ঘ্রাণ পেরিয়ে এখন কিছুটা কাঁচা আমের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। আম এখন সারা দেশের ফল, যা বাণিজ্যিক কৃষির কাতারে পৌঁছে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন–বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। আমাদের অনেক ফল নিয়েই বাড়ছে স্বপ্ন। গত বছর থেকে বাংলাদেশ আম রপ্তানি শুরু করেছে।
এফএওর মতে, বিশ্ববাজারে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের আম যখন পাকে, তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোনো দেশের আম আসে না। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা বাংলাদেশের আম কিনছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের আম বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল। বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎপাদন করতে পারে, তাহলে বছরে ১ হাজার টন আম রপ্তানি করাও সম্ভব। কিন্তু আমচাষিরা পড়েছেন এক বিড়ম্বনায়। ২০১৪ সাল ছিল তাঁদের জীবনের কালো অধ্যায়, তঁারা এটা ভুলতে পারেন না। আমে বিষাক্ত ফরমালিনসহ নানা রকম রাসায়নিক মেশানোর অভিযোগ এনে ঢাকা শহরের সবগুলো প্রবেশমুখে ব্যাপক তল্লাশি করে ট্রাক ট্রাক আম ধ্বংস করা হয়। পরবর্তীকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, আম পরীক্ষার জন্য প্রশাসন যে যন্ত্র ব্যবহার করেছিল, সেই যন্ত্রই ঠিক ছিল না। সেটি ছিল বাতাসের ফরমালিন মাপন যন্ত্র।
তার পরের বছর অর্থাৎ গতবার আম নিয়ে সংশয় এড়ানোর জন্য প্রশাসন আম পাড়ার একটি তারিখ নির্ধারণ করে দেয় বলে জানা যায়। খোঁজ পেয়ে আমি মৌসুমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় যাই। যদিও গতবার আমের ভরা মৌসুম পড়েছিল রমজান মাসে, দেশে আমের ফলন যেমন ভালো ছিল, মানুষ আম নিঃসংশয়ে খেতেও পেরেছে। তবে বাগানে বাগানে গিয়ে চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে শুনেছি, আম ভাঙার তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে তঁারা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তারিখ নিয়েও ছিল নানা বিভ্রান্তি। প্রশাসন, আম গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ছিল একেক রকম ধারণা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ গোলমেলে হয়ে ওঠে।
এবার আমের মৌসুমের শুরু থেকেই গত দুই বছরের লোকসান ও ঝামেলার কারণে সংশয় জেঁকে বসেছে আমবাগান মালিক, ব্যবসায়ীসহ আমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মনে। কয়েক দিন আগে রাজশাহীর আমপ্রধান এলাকা চারঘাটের পান্নাপাড়ার এক আমবাগানে জেলার বিভিন্ন এলাকার আমচাষিদের এক সমাবেশে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে বাগানমালিক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আম উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই শতাধিক লোক উপস্থিত ছিলেন। চাষিরা বলছিলেন, ২০১৩ সাল থেকে আম বাজারজাতকরণ নিয়ে নতুন সংকটের মুখে পড়েছেন তঁারা। ফরমালিনের অভিযোগে তাঁদের সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে। এই অভিযোগের কারণে বাগানমালিক বা ব্যবসায়ীরা নিজের বাগানের আম পাড়তেও সংশয়ে পড়েছেন। আম বাজারে নিতে গিয়ে প্রশাসনের হয়রানির মুখে পড়েছেন। অনেকের ঝুড়িবোঝাই আম রাস্তায় পিষ্ট করা হয়েছে।
এরপরই গত বছর থেকে এসেছে আম পাড়ার তারিখের খড়্গ। চাষিদের কথা হচ্ছে, ‘কোন জাতের আম বা কোন বাগানের আম কখন পাকবে, এটা চাষির চেয়ে প্রশাসন কি ভালো জানে?’ তাঁরা স্পষ্ট করে বারবার বলছিলেন, ‘কোনো বাগানমালিক তাঁর আমে কখনো রাসায়নিক মেশান না। ফরমালিন কী জিনিস, আমরা তা জানি না।’ তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছিলেন, ‘আমের মতো ফলে কখনো ফরমালিন মেশানো যায় না। মেশালে আমের স্বাভাবিকতা কখনোই থাকবে না।’ একই কথা আমি বিজ্ঞানীদের কাছেও শুনেছি। তাঁরা বলছেন, চাষিদের হয়রানি না করে সরকার বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখুক, কারা ক্ষতিকর উপাদান মেশাচ্ছে। আমে বাড়তি রাসায়নিক থাকলে তা কোন পর্যায়ের, কে প্রয়োগ করেছে—এই বিজ্ঞানের যুগে তা বের করা মোটেও অসম্ভব নয়। তা ছাড়া, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্ব যেহেতু সরকারের, সেহেতু যেকোনো পণ্যের শুদ্ধতা নিরূপণে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
>কেউই চান না গাছের আম পাড়ার জন্য কোনো তারিখ নির্ধারিত হোক। কৃষক কখনোই বাগানের আমে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু প্রয়োগ করেন না। আর ফরমালিন নামের কোনো কিছু তাঁরা চেনেনও না
বাগানমালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেল, আম সংগ্রহের পর তাঁরা কখনো কখনো ‘ইথেফন’ বা ‘ইথরিল’ নামের রাইপেন হরমোন প্রয়োগ করেন। তঁারা কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় কীটনাশকের দোকানির পরামর্শে এসব ব্যবহার করেন। এ–জাতীয় হরমোনের পরিমিত ব্যবহার ক্ষতিকর নয় বলেও বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন।
যা হোক, পরিস্থিতি যখন এই পর্যায়ে তখন কেউই চান না গাছের আম পাড়ার জন্য কোনো তারিখ নির্ধারিত হোক। বিষয়টি নিয়ে আমি ফল গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহীর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীমউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেন, গাছ থেকে আম ভাঙার তারিখ থাকা একেবারেই উচিত নয়। দেশের আটি আম (স্থানীয় জাতের আম) থেকে শুরু করে একেক জাতের আম একেক সময়ে পাকে। বাগানের ব্যবস্থাপনা, আবহাওয়াসহ নানা কারণে কোনো কোনো বাগানে আম পাকার ক্ষেত্রে তারতম্যও ঘটে থাকে। কৃষক কখনোই বাগানের আমে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু প্রয়োগ করেন না। আর ফরমালিন নামের কোনো কিছু তঁারা চেনেনও না।
এর মধ্যে আরেক শুভংকরের ফাঁকির সন্ধান পাওয়া গেল। জানলাম, গতবার প্রশাসনের পক্ষÿ থেকে লিখিতভাবে কোনো তারিখই বেঁধে দেওয়া হয়নি। এটি নানাভাবে কানাঘুষা ও গুজবে গুজবে ছড়িয়ে গেছে সব খানে। এর সত্যতা এখনো সবার কাছে অজানা। আমি রাজশাহী থেকে ফিরে আসার সময় এই ইস্যু নিয়ে বসেছিলাম জেলা প্রশাসক কাজী আশরাফউদ্দিনের সঙ্গে। তাঁকে পুরো বিষয়টি জানিয়ে
এলাম। বিনীত অনুরোধও করে এলাম এই বলে যে, আমের মৌসুমে কৃষকের যেন কোনোভাবেই ÿক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা সমীচীন।
আম নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষণা করছেন রাজশাহীর মাহবুব সিদ্দিক। তিনি আম নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। কোন আম কখন গাছ থেকে ভাঙতে হবে, এ নিয়ে তার প্রণীত একটি ক্যালেন্ডার রয়েছে। ওই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী গোবিন্দভোগ ১৫ মে থেকে ৩০ মে, গোপালভোগ ২৫ মে থেকে ১০ জুন, রানিপছন্দ ১ জুন থেকে ১৫ জুন, ÿরসাপাত ৭ জুন থেকে ৩০ জুন, হিমসাগর ১০ থেকে ৩০ জুন, নাক-ফজলি ৮ থেকে ২৫ জুন, বোগলাগুটি ১২ জুন থেকে ৭ জুলাই, বারি আম-২ বা লক্ষ্মণভোগ ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই, বোম্বাই ১২ জুন থেকে ৫ জুলাই, ল্যাংড়া আম ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই, আম্রপালি ২৮ জুন থেকে ২৫ জুলাই, সূর্যপুরি ১ জুলাই থেকে ২০ জুলাই, ফজলি ৫ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট, বারি আম ৪-৭ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই, মল্লিকা ৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট, মোহনভোগ ৮ থেকে ৩০ জুলাই, চৌষা ১০ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট, আশ্বিনা ২০ জুলাই থেকে ৩০ আগস্ট এবং গোবিন্দভোগ ২০ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর। মাহবুব সিদ্দিকের এই ক্যালেন্ডারটিও সাধারণ কৃষকের অভিজ্ঞতা ও আমবাগানের বাস্তবতার আলোকেই প্রণীত। সময়ের প্রয়োজনে ভোক্তারা এগুলো রপ্ত করে নেবেন।
শাইখ সিরাজ: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই।
[email protected]