জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট অধ্যবসায় করেছেন। গত চার বছরে তিনি পুতিনের সঙ্গে ১২ বারেরও বেশি দেখা করেছেন। এ মাসে তিনি পুতিনকে টোকিওতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এমনকি তিনি পুতিনকে নিজের শহর নাগাতোয়ও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আবে যে পুতিনের মন ভজানোর চেষ্টা করছেন, তাতে জাপানের তেমন লাভ হয়নি, যদিও রাশিয়ার হয়েছে।
>পুতিনের জন্য আবে যে রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন, তা থেকে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো মুনাফা আসবে, তেমনটা মনে হয় না
জাপান চীনের পাল্টা ক্ষমতা হিসেবে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা করছে, তার অংশ হিসেবেই তিনি পুতিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছেন। তিনি এশিয়ায় ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করতে চান, যেখানে জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত একটি কৌশলগত চতুর্ভুজ গড়ে তুলবে। আবে ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তিনি রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নে নজর দিচ্ছেন, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান রাশিয়ার সঙ্গে কখনো শান্তিচুক্তি করেনি, আঞ্চলিক ক্ষমতা বিন্যাসে এটি একটি গলদ।
কিন্তু আবে যে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাচ্ছেন, তার লক্ষ্য কিন্তু শুধু চীনা আগ্রাসন ঠেকানো নয়। তিনি আরও চান, রাশিয়া যেন তাঁর সবচেয়ে দক্ষিণের সম্পদ-সমৃদ্ধ কুরিল দ্বীপ ফিরিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র যখন হিরোশিমায় বোমা ফেলে, তখন রাশিয়া এই দ্বীপ দখল করে নেয়। এর বদলে আবে পুতিনকে অর্থনৈতিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন, একই সঙ্গে তিনি রাশিয়ার অবহেলিত দূর পূর্বাঞ্চলে বিনিয়োগও করতে চেয়েছেন; বড় ধরনের জ্বালানি চুক্তির প্রস্তাবসহ।
আবে বেশ কিছু বাধার মুখে পড়েছেন। মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালের মার্চ মাসে রাশিয়া ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে কটি দেশ তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, জাপান তার মধ্যে একটি। এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া জাপানের চিরশত্রু চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, পুতিন জনসমক্ষে এই নিষেধাজ্ঞাকে জাপানের সঙ্গে শান্তির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আবের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পুতিন নাছোড়বান্দার মতো দর-কষাকষি শুরু করেছেন। চারটি বিতর্কিত দ্বীপে রাশিয়া নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে। ওদিকে এ মাসের শীর্ষ বৈঠকের আগে তিনি জাপানি গণমাধ্যমকে বলেছেন, বর্তমানে ভূমির যে বন্দোবস্ত রয়েছে, তা রাশিয়ার স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা ও তেলের কম দামের কারণে রুশ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সালে দেশটির অর্থনীতি শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ সংকুচিত হবে। ফলে পুতিন এখন ভূমি ছাড়ার ব্যাপারে আগের চেয়ে আরও বেশি অনাগ্রহী হয়ে উঠেছেন, পাছে রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থের কট্টর রক্ষক হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
এ অবস্থায় আবে পুতিনকে যে উদ্দেশ্যে দাওয়াত দিয়েছিলেন, তা চরিতার্থ হয়নি। তিনি ভূমি ফেরত পাচ্ছেন না, যদিও পুতিন ৬৮টি নতুন বাণিজ্য চুক্তির দলিল বগলদাবা করে বাড়ি ফিরেছেন। অনেক চুক্তিই প্রতীকী, কিন্তু কিছু কিছু চুক্তি বাস্তব, যার মধ্যে আছে ২৪০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি। এ ছাড়া তাঁদের মধ্যে ১০০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ তহবিল গড়ে তোলার চুক্তি হয়েছে।
শেষোক্ত চুক্তির অধীনে বিতর্কিত দ্বীপগুলোতে জাপান ও রাশিয়ার যৌথ অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘বিশেষ কাঠামো’ গড়ে তোলার কথা রয়েছে। রুশ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পিটার শেলাকায়েভ ইঙ্গিত দিয়েছেন, এ ধরনের কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিছু আইনি বাধা রয়েছে। যে জাপানি কোম্পানিগুলো কুরিল দ্বীপপুঞ্জে ব্যবসা করছে, তাদের রুশ সরকারকে কর দিতে হবে। আর জাপান যদি সেটা করে, তাহলে বোঝা যাবে, তারা এই দ্বীপপুঞ্জের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়েছে। সাম্প্রতিক শীর্ষ বৈঠকের পর আবে এটা খোলাসা করেছেন, পুতিন ১৯৫৬ সালের জাপান-সোভিয়েত ইউনিয়ন চুক্তি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, যেখানে বলা হয়েছিল, শান্তিচুক্তি হলে চারটি দ্বীপের মধ্যে ছোট দুটি দ্বীপ জাপানকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এ বছর সেই যৌথ ঘোষণার ৬০তম বার্ষিকী পূর্ণ হয়েছে, যেটা তখন বেশ বড় ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ক্রেমলিন এখন বলছে, তারা কিছু শর্তের বিনিময়ে দ্বীপ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা হলো জাপান রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা জোটে যেতে পারবে না।
জাপান রাশিয়ার উদ্বেগ আমলে নেওয়ার মতো জায়গায় নেই। তারা যেমন মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা জমানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির ক্ষেত্রে কুরিলকেও বাদ দিতে পারে না। বিশেষ করে, তারা যখন বিতর্কিত সেনকাকু দ্বীপের মালিকানা বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য অঙ্গীকার চাচ্ছে, তখন তাদের পক্ষে রাশিয়ার উদ্বেগ আমলে নেওয়া কঠিন।
মনে হচ্ছে, পুতিন নিজের অবস্থান নিয়ে বেশ আত্মতৃপ্ত। তিনি শীর্ষ বৈঠকে শুধু তিন ঘণ্টা দেরি করেই আসেননি, বিদেশি নেতাদের বসিয়ে রাখা তাঁর স্বভাব, তিনি জাপানিদের দেওয়া উপহারসামগ্রীও নেননি।
পুতিনের জন্য আবে যে রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন, তা থেকে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো মুনাফা আসবে, তেমনটা মনে হয় না। জাপানের সংকট শুধু গভীরতরই হবে। হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এতে আবে আরও বেশি করে পুতিনের কৃপাদৃষ্টি লাভের চেষ্টা করবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাশিয়া যদি যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পেয়ে যায়, তাহলে তার আর জাপানকে দরকার পড়বে না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক।