পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন আবদুল কাদের মিয়া। একাত্তরে ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে কর্মরত ছিলেন পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ থানায়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৭ মার্চ দেবীগঞ্জ থানায় তিনি বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করে ঘোষণা করেছিলেন, এখন থেকে এই এলাকা স্বাধীন।
তখন থেকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য তরুণ-যুবকদের তিনি অনুপ্রাণিত করতে থাকেন।
যুদ্ধ করতে ইচ্ছুকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের হাতে থানার অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেন। নিজেও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন।
যুদ্ধের জন্য আরও অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একবার সীমান্তের ওপারে হলদিবাড়িও গিয়েছিলেন।
৩১ মে আবদুল কাদের মিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয়।
এই যুদ্ধে দুজন প্রতিরোধযোদ্ধা নিহত ও তিনিসহ কয়েকজন আহত হন। তাঁর দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
আহতাবস্থায় তিনি কোনোরকমে তাঁর বাড়িতে (কর্মস্থলের বাসস্থান) আসেন।
এদিকে এলাকার পাকিস্তান-সমর্থক শান্তি কমিটির লোকেরা আবদুল কাদের মিয়ার বাড়িতে আসার খবর জেনে যায়।
তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে খবর দেয়। পরদিন সেনারা তাঁকে আটক করে। পরে ব্রুজেরডাঙ্গা (ভূষিরবন্দর) নামক স্থানে হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়।
স্বাধীনতার পর সেখানে আবদুল কাদের মিয়ার জুতা, মোজা, আংটি ও কলম পাওয়া গিয়েছিল।
এ ঘটনার বর্ণনা জানা যায় আবদুল কাদের মিয়ার মেয়ে নূরজাহান বেগমের ‘আমার বাবা’ রচনা থেকে।
নূরজাহান বেগম লিখেছেন, ‘আহত অবস্থায় পালিয়ে বহুকষ্টে বাবা আমাদের বাসার কাছাকাছি এক ভদ্রলোকের বাসায় আশ্রয় নেন।
আমি তাঁর নাম জানি না। সেই হৃদয়বান ব্যক্তি নিজ হাতে রাতে বাবার ক্ষতস্থানগুলো গরম পানি, ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করেন।
একজন গ্রাম্য কবিরাজ ডেকে এনে কি কি লতাপাতা বেটে ক্ষতস্থানে প্রলেপ দিয়ে কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন।
তারপর বাবার অনুরোধেই গভীর রাতে বাবাকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দেন। কে জানত এই আসাই বাবার শেষ আসা হবে!
‘বাবাকে আহত অবস্থায় দেখে আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠি। মা আমাকে ধমক দিয়ে চুপ করে দেন। ছোট ভাইবোনরা ঘুমিয়ে ছিল।
মাকে দেখে মনে হয়েছিল বাবা আসাতে তিনি মোটেই খুশি হননি। মা অস্থির হয়ে এক নিঃশ্বাসে বললেন, “তোমার এখানে না এলেই ভালো হতো।
আমি না তোমাকে বারণ করে দিয়েছিলাম। এখন আর্মিরা যদি জেনে ফেলে তুমি এসেছ, তাহলে কি হবে বলো, তুমি চলে যাও, চলে যাও এখান থেকে।” বাবা উত্তরে বললেন, “তোমরা যদি মরে যাও, আমার বেঁচে থেকে কি হবে।
বরং চলো আমরা সবাই ভোরে অন্য কোথাও চলে যাই। মরলে সবাই একসঙ্গে মরব, বাঁচলে একসঙ্গে।” মা বললেন, “আমাদের নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।
তুমি মুক্তিযোদ্ধা। শত্রুরা জানতে পারলে তোমাকে বাঁচতে দিবে না।”
‘অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন বাবা। টুকটাক ওষুধ ও সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই তখন ছিল না।
ভোর না হতেই যমদূতের মতো তদানীন্তন পিস কমিটির সেক্রেটারি আরো ২-১ জনকে সঙ্গে করে এসে বাবাকে ডাক দেয়।
ওরা খোঁজখবর নিয়েই এসেছে। তারপর সাড়ে আটটা-নয়টা হবে। আমি দরজা খুলে সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়েছি। বাইরে তাকিয়ে দেখি লোকজন দৌড়ে পালাচ্ছে।
আমি চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করি, কি হয়েছে? একজন বলে, “মেলিটারি, মেলিটারি।” আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে বলি, মা, মিলিটারি এসে গেছে।
‘মা আমাকেসহ বড় মেয়েদেরকে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বললেন। আমরা বাসা ছেড়ে অন্য একটা বাসায় গেলাম।
পরে শুনেছি বাবা বহুকষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমার ক্লাসমেট ফারজিনাদের বাসা যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাসার সামনে আর্মিদের জিপ থামে।
কিছুক্ষণ পর কে যেন বাবাকে মিথ্যা সংবাদ দেয়, “আপনার বৌ-ছেলেমেয়েদের আর্মিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে।” কোনো পুরুষ মানুষ এ সংবাদ শুনে চুপ থাকতে পারে না।
আমার যুদ্ধাহত বাবাও চুপ থাকতে পারেননি। তিনি তখন যান বাসায়। বাবাকে দেখতে পেয়েই হানাদার বাহিনী টেনেহিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে যায়। সেদিন ছিল ১ জুন, রোজ মঙ্গলবার।’
(পরিমার্জিত। স্মৃতি: ১৯৭১, সপ্তম খণ্ড, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, প্রকাশ ১৯৯৫)।
আবদুল কাদের মিয়ার জন্ম ১৯৩০ সালের ১ এপ্রিল, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা গ্রামে। বাবা কসিম উদ্দিন আহমেদ, মা আমেনা খাতুন।
তিনি নয় ছেলেমেয়ের জনক। দেবীগঞ্জে একটি সড়ক তাঁর নামে নামাঙ্কিত।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (অষ্টম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৯) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]